ইসমাইল আলী: চলতি বছরের শুরুতে বিদ্যুতের বাল্ক (পাইকারি) মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সে প্রস্তাবের ওপর গত ১৮ মে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তবে ৮৯ কার্যদিবস পর গতকাল সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ফলে আপাতত বাড়ছে না বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার। পুরোনো হারই বহাল থাকছে। আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে আর বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চাচ্ছে না সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। পরিবহন ভাড়ার বৃদ্ধির ফলে সব ধরনের পণ্য মূল্য বেড়ে গেছে। উপরন্তু বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে অসহনীয় লোডশেডিং। এর মধ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত সরকারের ইমেজের আরও ক্ষতি করতে পারে। তাই সবদিক বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুতের মূল্যহার না বাড়ানোর ফলে পিডিবির লোকসান ও ভর্তুকিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা নিরূপণ করতে চাইছে সরকার। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে বেশকিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। শিগগিরই অর্থ বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে জরুরি বৈঠক করবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিইআরসি। পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল, সদস্য মকবুল ই ইলাহি, বজলুর রহমান, আবু ফারুক, মো. কামরুজ্জামান, সচিব খলিলুর রহমানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘পিডিবি গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের পাইকারি দাম পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব জমা দেয়। ১৮ মে তাদের প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি করা হয়েছে। ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা, যার আজ ছিল শেষ দিন। আমরা এর মধ্যে অনেকবার বসেছি। আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করেছি। সব পর্যালোচনা করে কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের প্রস্তাবের সব বিবেচনা করে দাম পুনর্নির্ধারণ করা হলো না। আগের দামই থাকবে।’
যদিও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫-২৫ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে ছিল বিইআরসি। তা বিদ্যুৎ বিভাগে গত সপ্তাহে পাঠানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সরকার কতটা ভর্তুকি দেবে তার ওপর নির্ভর করবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির হার। তবে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেনি বিইআরসি। এক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিটি কোম্পানি মুনাফায় রয়েছে। তাই বাল্ক বিদ্যুতের দাম কিছুটা বাড়ালে তাদের খুব একটা সমস্যা হবে না।
সূত্র জানায়, বিইআরসির প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী সম্মত হননি। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকায় চূড়ান্ত প্রস্তাব তার কাছে যায় চলতি সপ্তাহে। তবে তিনি গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর সৃষ্ট অস্থিরতা ও জনগণের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সুপারিশ খারিজ করে দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি ওই সিদ্ধান্ত জানাল।
প্রসঙ্গত, পিডিবি ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা। বাকি ৩ টাকা ৩৯ পয়সা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। তবে বিইআরসির কারিগরি কমিটি গণশুনানিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ভর্তুকি ছাড়া ৮ টাকা ১৬ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করে। এক্ষেত্রে পাইকারি পর্যায়ে ৫৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়েও দাম বৃদ্ধির সুপাারিশ করা হয়েছিল।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকার ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এটি দিয়ে পিডিবি ঘাটতি সমন্বয় করতে পারছে। এসব বিবেচনা করেই কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি ১৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে কিছুটা সাশ্রয় হয়েছে কিন্তু সেসবের সর্বশেষ ও সঠিক তথ্য আমাদের জানতে হবে।’
এদিকে পিডিবির দাম বৃদ্ধির শুনানি খারিজের দিনই বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে বেশকিছু তথ্য চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এক্ষেত্রে আগামী বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসভিত্তিক ভর্তুকির হিসাব চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গত অর্থবছর পাইকারি বিদ্যুতের ওপর আরোপ করা ৬ শতাংশ উৎসে করের ফলে বিদ্যুৎ খাতে কী প্রভাব পড়ছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েলের ওপর শুল্ককর প্রত্যাহারের প্রভাবও জানতে চাওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ফার্নেস অয়েল আমদানির ওপর ২০১১ সালে শুল্ককর প্রত্যাহার করা হয়েছিল। ২০২০ সালের জুনে তা শেষ হয়ে যায়। ফলে বর্তমানে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সাড়ে ২৮ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এতে বছরে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ছয় হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এছাড়া বাল্ক বিদ্যুৎ বিতরণের ওপর ছয় শতাংশ উৎসে কর আরোপের ফলে অতিরিক্ত কেটে নেয়া হচ্ছে দুই হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।
এদিকে গত অর্থবছর পিডিবির ঘাটতি ছিল ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ভর্তুকি এ পর্যন্ত ছাড় করা হয়েছে ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আরও ১৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ফার্নেস অয়েল আমদানিতে শুল্ককর আরোপ করা হলেও তা পাসথ্রু হয়। অর্থাৎ ওই তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা বিল আকারে জমা দেয় কোম্পানিগুলো। পরে সে বিল যায় অর্থ বিভাগে। তারা সে অর্থ পুনরায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পরিশোধ করে। এতে পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে। ফলে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর বিল পেন্ডিং থাকার সময়সীমা বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এসব সমস্যা সমাধান ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের কতটা ভর্তুকি লাগতে পারে, তা পর্যালোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক করা হবে। জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বেশকিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। এগুলো আগামী সপ্তাহে পাঠানো হবে। এরপর এসব বিষয় নিয়ে অর্থ ও বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। তবে কবে এ বৈঠক হবে, তার তারিখ চূড়ান্ত হয়নি।
সূত্রমতে, গত এক যুগে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯ বার। এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। সবশেষ দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যা ওই বছরের মার্চ থেকে কার্যকর হয়। ওই সময় পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
এদিকে জুনে গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। এরপর চলমান লোডশেডিংয়ের মধ্যেই ৬ আগস্ট থেকে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। ডিজেলে সাড়ে ৪২ শতাংশ এবং পেট্রোল-অকটেনের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫১ শতাংশ। এরপর ব্যাপক সমালোচনার মুখে এক মাসের মাথায় লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। তাই এখন আর নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চাচ্ছে না সরকার।
উল্লেখ্য, নিজেরা উৎপাদনের পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি ও বেসরকারি মালিকানাধীন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা হিসেবে তা পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। এছাড়া পিডিবি নিজে ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহরাঞ্চলে বিতরণ করে থাকে।