রহমত রহমান: চলছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, যার প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। ব্যবসায় মন্দার মধ্যেও সদ্যবিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসে ভ্যাট আদায়ে বাজিমাত হয়েছে। এ মাসে ভ্যাটে শুধু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনই নয়, অতিরিক্ত আদায় হয়েছে এক হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক শূন্য চার শতাংশ, যেখানে সেপ্টেম্বর মাসে এনবিআরের মোট প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ভ্যাটের পেছনে দৌড়াছে আয়কর। সেপ্টেম্বর মাসে আয়কর খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২২৫ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে। আয়করে এ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। যদিও সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে কাস্টমস। এ মাসে শুল্ককর আদায় প্রবৃদ্ধি মাইনাস ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থনীতিতে সংকট চলছে। তবে তদারকি বৃদ্ধির ফলে ভ্যাটে বাজিমাত হয়েছে। সঙ্গে প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে। ৩০ নভেম্বরে ব্যক্তিশ্রেণির রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা রয়েছে। ফলে চলতি অক্টোবর মাসে রিটার্ন দাখিলের সঙ্গে কর আদায়ও বাড়ছে। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আয়কর আদায়ে রেকর্ড হবে। ভ্যাটের পেছনে আয়করও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য দৌড়াচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির প্রভাব পড়েছে শুল্ককর আদায়ে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে কাস্টমসের শুল্ককর আদায় সামনে আরও কমে যাবে।
এনবিআরের হিসাবমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক বা প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাটে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। তিন মাসে ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ হাজার ৬৪১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৫৪৭ কোটি ৯ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৯৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে। তবে প্রথম প্রান্তিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৯৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত অর্থবছর প্রথম প্রান্তিকে আদায় হয়েছিল ২১ হাজার ৯২ কোটি ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছর প্রথম প্রান্তিকে তিন হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা বেশি ভ্যাট আদায় হয়েছে। তিন মাসে ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
হিসাবে দেখা গেছে, ভ্যাট খাতে সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল আট হাজার ২১৪ কোটি দুই লাখ টাকা। আদায় হয়েছে ৯ হাজার ৫১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি আদায় হয়েছে এক হাজার ২৯৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ১১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত অর্থবছর সেপ্টেম্বর মাসে ভ্যাট আদায় হয়েছিল আট হাজার ১২৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর সেপ্টেম্বর মাসে গত অর্থবছর একই সময়ের তুলনায় এক হাজার ৩৮৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে। এই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে প্রবৃদ্ধি অর্জনের শীর্ষে রয়েছে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট। সেপ্টেম্বর মাসে এ কমিশনারেটের আদায় প্রবৃদ্ধি ৪৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে শীর্ষে এলটিইউ। এলটিইউ সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৯৫২ কোটি ৭১ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা উত্তর ২৫ দশমিক ১১ শতাংশ, কুমিল্লা ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ, খুলনা ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ, সিলেট ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ঢাকা দক্ষিণ ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ, ঢাকা পশ্চিম ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ঢাকা পূর্ব ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ, রাজশাহী ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যশোর ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও রংপুর মাইনাস ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
অপরদিকে আয়কর খাতে সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রা ৯ হাজার ৫০৩ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯ হাজার ৭২৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি আদায় হয়েছে ২২৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ১০২ কোটি ৩৮ শতাংশ। একই মাসে গত অর্থবছর আদায় হয়েছে ৯ হাজার ৮৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে গত অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় ৬৩৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে। আদায় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। প্রথম তিন মাসে আয়কর খাতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ১০২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক হাজার ৩৯০ কোটি ১৪ লাখ টাকা পিছিয়ে আছে।
অপরদিকে আমদানি-রপ্তানিতে (শুল্ক খাত) সেপ্টেম্বর মাসে ৯ হাজার ৯৪৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে সাত হাজার ৫৯১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দুই হাজার ৩৫৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে। যেখানে গত অর্থবছর একই মাসে আদায় হয়েছিল সাত হাজার ৭০৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। আদায় প্রবৃদ্ধি মাইনাস ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর প্রথম প্রান্তিকে শুল্ক খাতে আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৪৫৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ খাতে ঘাটতি দুই হাজার ৫৮৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভ্যাট খাতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে সব সময় কমিশনারদের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। সে অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। আয়কর ও কাস্টমস খাতে রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতা চিহ্নিত ও তা দূর করতে কাজ করা হচ্ছে।
এনবিআর সূত্রমতে, চলতি অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ভ্যাট খাতে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি, শুল্ক খাতে এক লাখ ১১ হাজার কোটি ও আয়কর খাতে এক লাখ ২২ হাজার ১০০ টাকা। প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শুল্ককর আদায়ে ঘাটতি সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে এনবিআর আদায় করেছে ৬৫ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। উল্লিখিত তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৭১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।