রোহান রাজিব: বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটছে। মূল্যস্ফীতির চাপে আমানত হ্রাসের কারণে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সামর্থ্য কমেছে। অন্যদিকে আমদানি কমায় ও সম্ভাব্য আর্থিক সংকটের আশঙ্কায় নতুন করে বিনিয়োগেও আগ্রহ হারাচ্ছে বেসরকারি খাত। এতে গেল সেপ্টেম্বরে এ খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমেছে। গত আগস্টেও এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশের বেশি। কিন্তু ব্যাংকে আমানত রাখলে সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ সুদ পাওয়া সম্ভব। তার ওপর রয়েছে ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের চার্জ। এতে ব্যাংকের পরিবর্তে নগদ টাকা হাতে রাখতেই পছন্দ করছেন গ্রাহকরা। ফলে ব্যাংক খাতে আমানত কমেছে।
অন্যদিকে কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশের আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অতিরিক্ত মূল্য খরচ করতে হওয়ায় ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ছিল। তবে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি ও ডলার সংকটের কারণে সেপ্টেম্বরে আমদানিতে ধস নেমেছে। এছাড়া লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে বিভিন্ন খাতে। তাই বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি ঋণের খুব একটা দরকার পড়ছে না। এতে আগের মাসের তুলনায় এ খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংক খাত থেকে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছেন। আগের মাস আগস্টে গত বছরের আগস্টের চেয়ে বেশি নিয়েছিলেন ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে বকেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১২ লাখ ১০ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের আগস্টে ছিল ১৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শেয়ার বিজকে বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণের একটা বিরাট অংশ আমদানির সঙ্গে জড়িত। তাই আমদানি কমার কারণে এ খাতের গ্রোথ কমেছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে চাপে রয়েছে। তাই সবাই ঋণ কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা করছে। এজন্য ঋণ কমিয়ে দিচ্ছে সবাই।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত অর্থবছর ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেষ হয়। তবে গত আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণের যে প্রবৃদ্ধি ছিল, তা মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার প্রায় কাছাকাছি। তবে সেপ্টেম্বরে সে প্রবৃদ্ধি থেকে আরও কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, সেপ্টেম্বরে আমদানির পরিমাণ কমেছে। লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে। তাই বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণের খুব একটা দরকার পড়েনি। তাই আগের মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর আগে এ খাতে গ্রোথ হওয়ার কারণ, ডলারের রেট বেশি ছিল। তাই আমদানির ব্যয় টাকার অঙ্কে বেড়েছিল। তাই বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিও বেড়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ৫৭০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। আগের মাস আগস্টের তুলনায় যা ৬৩ কোটি ডলার বা প্রায় ১০ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে আমদানি এলসি নিষ্পত্তিও আগের মাসের চেয়ে ১৮ শতাংশ কমে ৬০০ কোটি ডলারে নেমেছে। আগের মাস আগস্টে আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল ৭৩৩ কোটি ডলার। এছাড়া গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি দুটোই কমেছে। এছাড়া গত অর্থবছরে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ফেব্রুয়ারিতে এ প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। এপ্রিল মাসে তা বেড়ে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে। মে মাসে তা আরও বেড়ে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ দাঁড়ায়। জুন মাসে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। জুলাই মাসে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশে ওঠে।
গত মে মাস থেকে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় দিয়ে ডলারের চাহিদা মিটছে না। এতে সংকট তৈরি হয়েছে। তাই রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে প্রতি ডলারের দাম ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ৯৭ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের চার মাসে রিজার্ভ থেকে ৪৮১ কোটি ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে রিজার্ভ কমে ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে।
যদিও ব্যাংকগুলোয় ডলার কেনাবেচা হচ্ছে আরও অনেক দামে। গত বুধবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগু?লো? আদমানি পর্যায়ে ডলারের দাম নিচ্ছে ১০০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৩ টাকা ৫৬ পয়সা।