সৈয়দা অনন্যা রহমান : শুধু রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়, মূলত শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতার একটি অবস্থাকে বলা হয় স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য জীবনের অমূল্য সম্পদ। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘আলমা আতা ঘোষণা’ সব মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ ঘোষণার অন্যতম প্রধান বিষয় ন্যায় বিচার। অর্থাৎ শুধু জনসংখ্যা নয়, সব মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় আয়ের স্তর, লিঙ্গ, বয়স, আবাসন, অভিবাসী অবস্থা ও নৃগোষ্ঠীর অগ্রগতিও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। শুধু চিকিৎসাকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অর্থ ব্যয় করা হলে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
গত ১০ বছরে যে হারে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়েছে ২০৪০-৪১ সাল এভাবে বৃদ্ধি পেলে এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রের জন্য একটি বিরাট সংকট তৈরি করবে। আরও আগে থেকে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল। তবে এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি। চূড়ান্ত সংকট তৈরি হওয়ার আগেই রোগ প্রতিরোধে অধিক গুরুত্ব দেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রে এরই মধ্যে পরীক্ষিত ও গৃহীত উদ্যোগগুলো দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্যের সঙ্গে পানি, মাটি, বায়ু, যাতায়াত, হাঁটা, শরীরচর্চা, সার্বিক পরিবেশ, বিনোদনের সুযোগÑসবকিছুর সম্পর্ক রয়েছে। একটি রাষ্ট্রে বহু ধরনের নানা বয়সী মানুষের বসবাস। গ্রাম ও শহর সবদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা যারা নগরে বসবাস করছি, তাদের স্বাস্থ্য এখন সবচেয়ে হুমকিতে। কারণ উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত নগরায়ণ এখন একটি বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। চকচকে গ্লাস আর এসিতে মোড়ানো সুউচ্চ সব ভবনের শহর অথচ গণপরিসরগুলোর অবস্থা ভালো নয়। এ ধরনের শহরগুলোকে কোনোভাবেই ভালো শহর বলা যাবে না। নগরের বসবাসরত শিশু এবং প্রবীণরা গণপরিসরের দুরবস্থার কারণে সারা দিন বন্ধঘরে টিভি এবং কম্পিউটারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে তারা নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব সংকট থেকে উত্তরণে নগর পরিকল্পনায় সবার ব্যবহার উপযোগী খোলা পরিসর, চলাচলের রাস্তা, গণপরিবহন, ভবনগুলোয় পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থার পাশাপাশি বিনোদন ও সামাজিকীকরণের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে।
শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের মানসিক সুস্থ্যতা অত্যন্ত জরুরি। মানসিক সংকটে বাড়ছে আত্মহত্যার মতো ঘটনা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণা অনুসারে, দেশে প্রতি লাখে আত্মহত্যা করছেন ৮ দশমিক ৫ (প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার) জন। ২০২১ সালে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ১০১ শিক্ষার্থী। শিশু, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে উঠতি বয়সে চারপাশের অজানাকে জানার, একটা কিছু করার আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। এ সময়টায় তাদের সময় এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া খুব জরুরি, যাতে তারা সুবিধাবাদী, সন্ত্রাসবাদী না হয়ে ওঠে এবং ভুল পথে পরিচালিত না হয়। মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও লাইব্রেরি থাকা জরুরি। আবার একেকজন মানুষ ধীরে ধীরে বৃদ্ধ বয়সে এসে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। কিন্তু কোয়ালিটি সময় ব্যয় করার মতো জায়গা না পেয়ে বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্বে ভোগে। এ সময়টায় যদি তরুণদের প্রাণশক্তি এবং বৃদ্ধদের অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটানো যায়, সেক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্র ভালো কিছু পেতে পারে।
সব বিষয় এককভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজকল্যাণ, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিককে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখার দায়িত্ব এককভাবে রাষ্ট্রের নয়, নাগরিকদেরও এক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যেমন সার্স ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়ে সচেতন করতে পারে, কিন্তু মাস্ক পরিধান করার দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানটি সমন্বয় ও গবেষণার আলোকে কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি যেমন প্রয়োজন, তেমনি এ ধরনের ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ ও সম্ভাবনাও আমাদের রয়েছে। এরই মধ্যে সারাদেশে স্থাপিত ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিককে সম্পৃক্ত করে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করতে পারে ‘হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন’। এ প্রতিষ্ঠানটি জরুরি অবস্থায় সমাজে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যঝুঁকি, মহামারি এবং নতুন নতুন অজানা রোগ প্রতিরোধে খুব দ্রুত সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন থাই হেলথ ফাউন্ডেশন কভিড-১৯ প্রতিরোধে কাজ করেছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে প্রতি বছরই সরকারের বাজেট ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় খাতগুলোয় অনেক সময় অর্থের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এখানে রাষ্ট্রীয় মূল রাজস্ব থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে এমন কিছু পণ্যের ওপর (যা সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন) সারচার্জ আরোপ করে সেই অর্থে এ ধরনের ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করা হয়। যেমন তামাক। এ পণ্য থেকে যতটা আয় হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাকজনিত রোগ ও অকাল মৃত্যুর কারণে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। সে সময়কালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে এ খাত থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজনÑকত টাকা পুড়িয়ে কত টাকা আয় করা হচ্ছে? ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবসা করা কোম্পানিগুলো মুনাফা অর্জনের জন্য জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি পরিবেশ ও অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনস্বাস্থ্যকে সব সময় বাণিজ্যের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে দায়বদ্ধ করার পাশাপাশি তামাক, কোমল পানীয়, ফাস্টফুড, একবার ব্যবহার্য প্লাষ্টিক পণ্যের মতো অন্যান্য পণ্যের ওপর উচ্চ হারে কর এবং সারচার্জ আরোপের উদ্যোগ নিতে হবে। এর মাধ্যমে একদিকে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, অপরদিকে রোগ প্রতিরোধে ব্যয় করার জন্য আর্থিক সংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব।
এছাড়া অস্বাস্থ্যকর পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো নানা ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচি (সিএসআর) পালন করে। সামাজিক দায়বদ্ধতার অর্থ হলো ব্যবসায়ের পাশাপাশি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এমন উপায়ে কাজ করতে হবে, যা সমাজকে উপকৃত করে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর এ ধরনের কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য থাকে নিজেদের পণ্যের সম্প্রসারণ। ফলে কোম্পানিগুলোর অধিকাংশ সিএসআর প্রকৃতপক্ষে সমাজের উন্নয়ন বা জনকল্যাণে যতটা না সহায়তা করে, তার চেয়ে বেশি সহায়ক সিএসআর পরিচালনাকারী কোম্পানির পণ্যের প্রচারে। বাংলাদেশে তামাক কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আড়ালে নীতিতে প্রভাব বিস্তারের দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়। ব্যবসা সচল রাখতে তামাক কোম্পানিগুলো সিএসআর, লবিং, অনুদান ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারসহ বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি ২০২১ সালে সিএসআর বাবদ ব্যয় করেছে সাড়ে ১২ কোটি টাকা এবং ব্যাংকগুলো এসময়কালে ব্যয় করেছে ৭৫৭ কোটি টাকা। অথচ প্রচারণার দিক থেকে তামাক কোম্পানিগুলো অনেক অগ্রসর। এক্ষেত্রে সরকার ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রমের বাজেট রাষ্ট্রীয় খাতে নিয়ে হেলথ প্রমোশনে ব্যবহার করতে পারে।
জীবন যাপন ও মানসম্মত জীবনযাপনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন মানসম্পন্ন জীবন যাপনে সহায়ক। ১৯৮৭ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে ভিক হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভিক্টোরিয়ান হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রচারণায় অগ্রসর। তারা মানুষকে তাদের স্বাস্থ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য উন্নত করতে সক্ষম করে। এ প্রতিষ্ঠানটির মূল ফোকাস রোগ প্রতিরোধ এবং সুস্বাস্থ্যের প্রচার। সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে কৌশলগত পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। অস্ট্রেলিয়ায় হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আঘাতজনিত অসুস্থতা এবং মৃত্যু কমিয়ে এনেছে। ভিক হেলথ স্বাস্থ্যকর খাবার বিষয়ক প্রচারণা, নিয়মিত শরীর চর্চা, তামাক নিয়ন্ত্রণ, অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করে, যা ভিক্টোরিয়ানদের স্বাস্থ্যকর, সুখী জীবনযাপন করতে সাহায্য করছে। থাই হেলথ, ভিক হেলথসহ বিশ্বের ২৩টি দেশ এরই মধ্যে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে থাই হেলথ এর প্রস্তাবিত বাজেট ছিল মোট বাজেটের এক শতাংশ। রোগের চিকিৎসায় প্রতিবছর রাষ্ট্রকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। যদি ১০০ ডলার ব্যয় করতে হয় তাহলে অন্তত এক ডলার রোগ প্রতিরোধে ব্যবহার করতে হবে। আর্থিক বিবেচনায় এক ডলার খুবই সামান্য, কিন্তু এই এক ডলারই চিকিৎসার পিছনে ব্যয়কৃত ১০০ ডলারের তুলনায় থাইল্যান্ডে রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ ফাউন্ডেশনগুলো জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশেও হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা যায়। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হলে কমে আসবে চিকিৎসা ব্যয় এবং উন্নয়ন ঘটবে জনস্বাস্থ্যের।
উন্নয়ন কর্মী
syeda-anonna@yahoo.com