ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালের পর থেকেই দেশে বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। পাশাপাশি বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। তবে দুই অর্থবছর ধরে এ বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসায় বেড়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ। পাশাপাশি গ্যাস ও তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে জ্বালানি ব্যয়ও বাড়ছে। এতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। চলতি অর্থবছর তা আরও বেড়ে যাবে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক প্রতিবেদনে গত দুই বছরের ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তুলনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে প্রায় ২৪ শতাংশ। এতে দুই বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে গড়ে প্রায় ৬৯ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় (আমদানিসহ) সাত হাজার ৮৫২ কোটি ৫৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৪৯ হাজার ২৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ছয় টাকা ২৭ পয়সা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় ছিল জলবিদ্যুতে। এক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়ে দুই টাকা ৭৯ পয়সা। এছাড়া গ্যাসে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হয় তিন টাকা ২১ পয়সা, কয়লায় আট টাকা ৮৪ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (সৌর ও বায়ু) ১২ টাকা ৩৩ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ১২ টাকা ৩৭ পয়সা এবং ডিজেলে ৫৩ টাকা ১৮ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়েছিল পাঁচ টাকা ৮০ পয়সা।
২০২১-২২ অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় (আমদানিসহ) আট হাজার ৩৮২ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭১ হাজার ৪৩১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় আট টাকা ৫২ পয়সা। এর মধ্যে জলবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হয় দুই টাকা ৬২ পয়সা, গ্যাসে তিন টাকা ৪৭ পয়সা, কয়লায় ১২ টাকা ৬৬ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (সৌর ও বায়ু) ১৩ টাকা আট পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ১৬ টাকা ৯৫ পয়সা এবং ডিজেলে ৩৬ টাকা ৪৩ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় ছিল ছয় টাকা ১১ পয়সা।
মূলত ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তুলনামূলক বেশি চালানোয় ওই খাতে গড় ব্যয় অনেকটা কমে আসে। আর গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চলে। এতে গ্যাসে গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। আর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি ব্যয় পড়ে বেশি। এছাড়া কয়লা আমদানিতে শুল্ককর আরোপ করা হয়। এতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।
এদিকে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছর মোট সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে (আমদানিসহ) আট হাজার ৯৮৫ কোটি ৯০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫ হাজার ৭২ কোটি টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা। এর মধ্যে জলবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই টাকা ২১ পয়সা, গ্যাসে চার টাকা তিন পয়সা, কয়লায় ১৬ টাকা ১৯ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সৌর ও বায়ু) ১৫ টাকা ৬২ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ২১ টাকা ৯৭ পয়সা ও ডিজেলে ৩৫ টাকা সাত পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে (আদানি ছাড়া) ইউনিটপ্রতি সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় টাকা ৪১
পয়সা। আর আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়বে সম্ভাব্য ১৭ টাকা ৮৭ পয়সা।
গ্যাস সরবরাহ হ্রাসে এ খাতের কেন্দ্রগুলো চলতি অর্থবছরে তুলনামূলক কম চালাতে হবে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লা ও ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। ফার্নেস অয়েল আমদানিতেও শুল্ককর আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া আদানির উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কেনার জন্য চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছরে বেশকিছু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এছাড়া খুব শিগগিরই উৎপাদন শুরু করবে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারতের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ আসা শুরু হবে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েই চলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর নন-ফুয়েল (ক্যাপাসিটি চার্জ এবং পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়) খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছর এ খাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর তা আরও বেড়ে দাঁড়াবে ৩৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয়ও বাড়ছেই। ২০২০-২১ অর্থবছর এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছর এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ১১২ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছর তা আরও বেড়ে দাঁড়াবে ৬০ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এর মূল কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লার মূল্য বৃদ্ধি এবং কয়লা ও ফার্নেস অয়েলে শুল্ককর আরোপ করা। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ায় নন-ফুয়েল খাতেও ব্যয় বাড়ছে। এজন্য বিদ্যুতের বাল্ক (পাইকারি) মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) তা খারিজ করে দেয়। এতে পিডিবির লোকসান অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাবে।