আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ: বাঙালির সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধিতে যেসব রাজনীতিবিদ নিজেকে উৎসর্গ করেছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু তাদের একজন। চট্টগ্রামে আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোধা ছিলেন তিনি। ’৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে তার অবদান অপরিসীম।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বনেদি পরিবারের সন্তান হলেও একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কেবল রাজনীতিই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। ১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তার বাবার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইনজীবী ও জমিদার। তার মায়ের নাম খোরশেদা বেগম। তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর উপজেলার স্বনামধন্য শিল্পপতি মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়ে নুর নাহার জামানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ওই বছরই ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় বৃত্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার চট্টগ্রাম মহানগরীর পাথরঘাটার জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি ’৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী।

স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে বয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানআম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রডাক্ট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গড়ে  তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল ও সিনথেটিক রেজিন প্রডাক্ট কিনে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দু’দশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরমিট মিল কিনে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি দু’দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ব্যক্তিজীবনে তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জনক।

আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, তবুও তিনি আমাদের অন্তরে চিরজাগ্রত। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তার স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও লালিত মূল্যবোধ। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সঞ্চয় ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোভ ও লালসার ঊর্ধ্বে থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে যে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন সংগ্রাম-আন্দোলনে, সে মানুষটি আজ তার নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত। মৃত্যুর আজ দশম বছর। তার মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।

মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর

সাবেক একান্ত সচিব

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০