কুইক রেন্টালের মতোই বোঝা হয়ে উঠবে সৌরবিদ্যুৎ!

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এ সময় তারা বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন করে। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে শেয়ার বিজ। তা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্ব

ইসমাইল আলী: বর্তমানে বেসরকারি মালিকানাধীন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে পাঁচটি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ১১৬ মেগাওয়াট। বেসরকারি আরও ১৮টি কেন্দ্র পাইপলাইনে রয়েছে, যেগুলোর সক্ষমতা ৯৯৮ মেগাওয়াট। সবমিলিয়ে বেসরকারি খাতে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ১১৪ মেগাওয়াট। তবে সৌরবিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছে ডলারে। আবার পাশের দেশ ভারতের তুলনায় ১০-২০ গুণ বেশি দামে সৌরবিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছে। এতে কুইক রেন্টালের মতো বোঝা হয়ে উঠছে সৌরবিদ্যুৎ।

আইএমএফের এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল গত ২ নভেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে বৈঠকে করে। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের প্রশ্ন ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী? এ সময় বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন গ্রহণযোগ্য নয়। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে পরিবেশের দূষণ কম হয়; সে জন্য এ জ্বালানি ব্যবহার উৎসাহিত করতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সে উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি তথা সৌরবিদ্যুতের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ চিত্র পর্যালোচনা করে শেয়ার বিজ। এতে দেখা যায়, বর্তমানে সরকারি মালিকানাধীন দুটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে। এ কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে ইউনিটপ্রতি ১৩-১৪ টাকা। সরকারি আরও দুটি কেন্দ্র নির্মাণাধীন ও পরিকল্পনাধীন রয়েছে আটটি।

এদিকে বেসরকারি খাতের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র পাঁচটি উৎপাদন শুরু করেছে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালে। এগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হচ্ছে প্রতি ইউনিটে ১৩ থেকে ১৯ সেন্ট বা ১৪ থেকে ২০ টাকা। আরও ৯টি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনায় চুক্তি (পিপিএ) সই হয়েছে, যেগুলোর সক্ষমতা ৫০৫ দশমিক ৭৭ মেগাওয়াট। এছাড়া এলওআই (লেটার অব ইনট্যান্ট) ইস্যু করা হয়েছে আটটি কেন্দ্রের, যেগুলোর সক্ষমতা ৪৪২ মেগাওয়াট। আর একটি কেন্দ্র পরিকল্পনাধীন থাকলেও এলওআই ইস্যু করা হয়নি, যার সক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় ধরা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ১১ থেকে ১৭ সেন্ট বা ১২ থেকে ১৭ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম ধরা হয়েছে সুনামগঞ্জে নির্মাণাধীন হাওর বাংলা সোলার পার্কে। এ কেন্দ্রটি থেকে সৌরবিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ সেন্ট। আর লালমনিরহাটে নির্মাণাধীন ইন্ট্রাকো সোলার পার্ক থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ সেন্ট এবং গাইবান্ধায় বেক্সিমকোর সোলার পার্ক থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ সেন্ট।

যদিও বিদেশি মালিকানাধীন বিভিন্ন সৌরবিদ্যুৎ থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় অনেক কম ধরা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় নির্মাণাধীন গ্রিড সোলার প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৭.৪৮ সেন্ট বা প্রায় আট টাকা। অর্থাৎ বিদেশি কোম্পানির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানির সৌরবিদ্যুৎ কিনছে সরকার। এছাড়া ডলারের চুক্তির ফলে দেশীয় মুদ্রায় অবমূল্যায়নে এ খাতে ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, সৌরবিদ্যুৎ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ডলারে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছে। মূলত বিভিন্ন দাতা সংস্থার পরামর্শে এ বিষয়টি যুক্ত করা হয়। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ইপিসি কন্ট্রাক্ট করা হয় ডলারে। তাই ডলারে বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ না করলে বিদেশি কোম্পানি এ খাতে এগিয়ে আসত না।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৌরবিদ্যুতে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে। এজন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো এ খাতে অনেক বেশি দক্ষ। তাই তাদের ব্যয় তুলনামূলক কম হয়। ফলে বিদ্যুতের দামও কম ধরা হয়েছে। তবে দেশীয় কোম্পানিগুলো এ ব্যবসায় নতুন আসছে। তাই তাদের ব্যয় বেশি পড়ছে। এজন্য বিদ্যুতের দাম বেশি ধরা হয়েছে। তবে পাইপলাইনে থাকা কেন্দ্রগুলোর ব্যয় আগের চেয়ে কমেছে।

যদিও পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, কুইক রেন্টালের মতো সৌরবিদ্যুতেও লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। ফলে প্রকৃতপক্ষে এ খাতে কত ব্যয় হতে পারে তার নির্দিষ্ট ধারণা পিডিবির নেই। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আসে। তখন তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করে ব্যয় ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়। তবে দেশীয় কোম্পানিগুলো নানা ধরনের তদবির করে রেট বাড়িয়ে নিচ্ছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি পড়ছে। এর অন্যতম উদাহরণ পাশের দেশ ভারত। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে ক্রমেই কমছে। ভারতে ২০১৯-২০ সালে ২ গিগাওয়াট (২ হাজার মেগাওয়াট) সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নিলাম করা হয়েছে। এতে দেশটি রেকর্ড কম দামে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে লাইসেন্স দিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে দুই টাকা ৭৩ পয়সা (২.৩৬ রুপি)।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একই সময়ে দুবাইয়েও ২ গিগাওয়াট (২ হাজার মেগাওয়াট) সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নিলাম করা হয়েছে। এতে দেশটিতে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে এক টাকা ৪২ পয়সা (১.৩৫ সেন্ট)। তবে এটি বিশ্বের সবচেয়ে কম ব্যয়ের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদাহরণ নয়। বরং বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে কম ব্যয়ে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নিলাম করা হয়েছে পর্তুগালে। দেশটিতে ৭০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে এ নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে দেশটিতে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে এক টাকা ১৬ পয়সা (০.০১১৪ ইউরো)।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০