নিজস্ব প্রতিবেদক: চলমান সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ঢাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা শেষে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কর্মকর্তা পর্যায়ের (স্টাফ লেভেল) চুক্তিতে পৌঁছেছে আইএমএফ। তবে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। এসব বিষয়ে একটি প্রতিবেদন আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদে জমা দেবে সফররত প্রতিনিধিদল। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ঋণ ছাড় করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদ।
ঢাকায় দুই সপ্তাহের সফর এবং আলোচনার ফলাফল তুলে ধরতে সচিবালয়ে আলাদা সংবাদ সম্মেলনে আসেন আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতা এবং সংস্থার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দ। সেখানে তিনি এসব বিষয় জানান।
বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করবেন। সভ আনুষ্ঠানিকতা সেরে আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে আইএমএফ বোর্ড এ ঋণ প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে পারে।
আইএমএফের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) এবং বর্ধিত তহবিল সুবিধা থেকে ৩২০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাবে বাকি ১৩০ কোটি ডলার দেয়া হবে।
এ ঋণের অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার হাতে নেবে, তার উদ্দেশ্য হবে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং দুর্দশায় পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়ে দৃঢ়, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি কমিয়ে আনতেও এই ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে।
আইএমএফ উল্লেখ করে, কভিড মহামারির ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বড় ধরনের চাপে পড়েছে; ডলারের বিপরীতে ধারাবাহিকভাবে মান হারাচ্ছে টাকা, মূল্যস্ফীতিও পৌঁছেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে। রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানিতে লাগাম টানায় অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে; জ্বালানি সংকটের মুখে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের মতো দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতেই গত জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল বাংলাদেশ। প্রাথমিক সম্মতি জানানোর পর শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্য রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আইএমএফ প্রতিনিধিরা গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় আসেন। গত দুই সপ্তাহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অংশীজনদের সঙ্গে তারা ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকের ফলাফল জানাতে গতকাল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল
সংবাদ সম্মেলনে রাহুল আনন্দ বলেন, ‘২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে বাংলাদেশকে অতীতের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধির চাকা আরও গতিশীল করার জন্য কাঠামোগত সমস্যাগুলোতে নজর দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ, উৎপাদন সুসংহত করা এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা গড়ে তুলতে হবে। এই বাস্তবতায় এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় নেয়া আগের উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার আইএমএফের সহযোগিতায় বাস্তবায়নের জন্য একটি পরিকল্পনা সাজিয়েছে, যা ঝুঁকি কমিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত করবে এবং সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জলবায়ু ঝুঁকি প্রশমনের কাজ ত্বরান্বিত করে শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।’
আইএমএফ বলছে, সরকারের অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রানীতির কাঠামোগত পরিবর্তন, আর্থিক খাতকে আরও শক্তিশালী করা, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অংশ।
আইএমএফের এ ঋণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে চারটি লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলোÑ অর্থনীতির বহিঃখাতকে স্থিতিশীল করা; ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ সামনে রেখে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেয়া; আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন ও সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া।