ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০০৬ সাল থেকে বড়পুকুরিয়ার কয়লা ব্যবহার করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সে সময় প্রতি টন কয়লার দাম ধরা হয়েছিল ৬০ ডলার। পরে তা চার দফা বাড়িয়ে ১০ বছরের মধ্যে করা হয় ১৩০ ডলার। এর পর ছয় বছর কয়লার দাম বাড়ানো হয়নি। তবে নতুন করে কয়লার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয় পিডিবিতে। এতে গত অর্থবছর ও আগামী ছয় বছরের কয়লা উত্তোলন এবং এর সম্ভাব্য ব্যয় দেখানো হয়। এর ভিত্তিতে প্রতি টন কয়লার দাম ১৭২ দশমিক ৫২ ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে কোল মাইনিং কোম্পানি। এটি বাস্তবায়িত হলে কয়লার দাম বাড়বে প্রতি টনে ৩৫ শতাংশ। যদিও কোল মাইনিং কোম্পানির প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে পিডিবি। এক্ষেত্রে প্রতি টন কয়লার দাম ১৩২ দশমিক ৮১ ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।
কোল মাইনিং কোম্পানির প্রস্তাবনামতে, গত অর্থবছর কয়লা বিক্রি করা হয় চার লাখ ৮৭ হাজার ৯২৬ মেট্রিক টন। এতে মোট ব্যয় দেখানো হয় ৫৮০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মেট্রিক টন কয়লার উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১১ হাজার ৯০৩ টাকা বা ১৩৮ দশমিক ৩৬ ডলার (১ ডলার=৮৬.০৩ টাকা)। আর প্রতি টন কয়লা পিডিবির কাছে বিক্রি করা হয় ১৩০ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি টন কয়লা বিক্রিতে কোল মাইনিং কোম্পানির লোকসান হচ্ছে আট ডলারের বেশি।
এদিকে চলতি অর্থবছর সম্ভাব্য কয়লা সরবরাহের পরিমাণ ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন, আগামী অর্থবছর সাত লাখ মেট্রিক টন, ২০২৪-২৫ অর্থবছর ছয় লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, ২০২৫-২৬ অর্থবছর আট লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, ২০২৫-২৬ অর্থবছর ৯ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর ছয় লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। এ ছয় বছর কয়লা সরবরাহে গড় ব্যয় পড়বে যথাক্রমে ১৮১ দশমিক ৫৫ ডলার, ১৪৪ দশমিক ৩১ ডলার, ২০৭ দশমিক ১০ ডলার, ১৮৩ দশমিক ১১ ডলার, ১৭৯ দশমিক ৮৭ ডলার এবং ১৫৬ দশমিক ৩২ ডলার (১ ডলার=১০৬ টাকা ধরে)। এতে প্রতি টন কয়লার গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ১৭৫ দশমিক ৫২ ডলার।
কয়লার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে কোল মাইনিং কোম্পানি জানায়, এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী খনির উত্তর দিকে কয়লা উত্তোলন করা হবে। এজন্য খনির উত্তরাংশ বর্ধিত করতে ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এজন্য এক হাজার ২০০ কোটি টাকা অবশ্যই লাগবে। এছাড়া চলতি অর্থবছর ১৫ দশমিক ৬৫ একর জমি খনির মধ্যভাগের জন্য অধিগ্রহণ করতে হবে। এজন্য ১১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ ব্যয়কে কয়লার দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এদিকে ২০২৪-২৫, ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছর উত্তরাংশের জমি অধিগ্রহণের জন্য ৪০০ কোটি টাকা করে ব্যয় বিবেচনায় ধরা হয়েছে। আর খনি থেকে কয়লা সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। এছাড়া জামালগঞ্জ কয়লা খনি ও আলিহাট লৌহ আকরিক খনি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং দিঘীপাড়াসহ অন্যান্য কয়লাক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। এ খাতে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, যা প্রতি বছর সমানভাবে বরাদ্দ ধরা হয়েছে সম্ভাব্য বাজেটে।
যদিও কোল মাইনিং কোম্পানির এ দুই প্রস্তাবে আপত্তি তুলেছে পিডিবি। সংস্থাটি মন্তব্য করে, বর্তমান চুক্তির অধীনে জমি অধিগ্রহণ ও অন্য কোনো প্রকল্পের অনুসন্ধান ব্যয় বাদ দিয়ে উৎপাদিতব্য কয়লার দাম নির্ধারণ করতে হবে। এতে প্রতি টন কয়লার সম্ভাব্য দাম পড়বে গড়ে ১৩২ দশমিক ৮১ ডলার। কয়লার দাম তাই এ হারেই নির্ধারণ করা উচিত।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে মতামত বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হবে। সেখানে আন্তঃবিভাগ সমন্বয়ের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করা হবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দাম খুব বেশি বাড়ার কথা নয়।
প্রসঙ্গত, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। আর খনির খননকাজ শেষে ২০০৫ সালে ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেয়া হয়। ওই বছর ১০ সেপ্টেম্বর থেকে খনি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু করা হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে পিডিবিসহ অন্যান্য খাতে কয়লা বিক্রি শুরু করা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ থেকে স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে কয়লা বিক্রি বন্ধ রাখা হয়। সে সময় থেকে শুধু পিডিবির কাছেই বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিক্রি করা হচ্ছে।
খনিটি থেকে উত্তোলনের শুরুতে পিডিবির জন্য প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ ডলার। ২০০৮ সালের ১ জুলাই তা বাড়িয়ে ৭০ ডলার, ২০১০ সালের ১ জুলাই ৮৪ ডলার, ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ১০৫ ডলার এবং ২০১৫ সালের ১ মে ১৩০ ডলার দাম নির্ধারণ করা হয়। সে সময় দেশীয় বিক্রেতাদের কাছে প্রতি টন কয়লার দাম নেয়া হতো ১০ হাজার ১৮৬ টাকা। তবে গত সাড়ে চার বছরে ধরে তা বন্ধ রয়েছে।
পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি কয়েক বছর ধরে চাহিদা অনুযায়ী কয়লা সরবরাহ করতে পারছে না। এজন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট প্রায়ই বন্ধ রাখতে হয়। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আর অন্য কয়লাখনি ও আকরিক খনির অনুসন্ধান ও উন্নয়ন ব্যয় পিডিবির ওপর চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। তা করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।
উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছর বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয়েছিল ১১ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৮ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় সাত লাখ ৫৩ হাজার ৯৭৩ মেট্রিক টন। গত অর্থবছর তা আরও কমে যায়।
বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিনটি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এজন্য প্রতিদিন কয়লার প্রয়োজন সাড়ে পাঁচ হাজার টন। কিন্তু খনিতে বর্তমানে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে দুই থেকে তিন হাজার টন। এছাড়া খনির যে স্তর থেকে বর্তমানে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে, সেখান থেকে প্রতিদিন তিন হাজার টনের বেশি কয়লা পাওয়া সম্ভব নয়। এতে প্রতিদিন ঘাটতি থাকে আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার টন। এর মধ্যে আবার বছরে শিফট পরিবর্তনের জন্য খনির কয়লা উত্তোলন তিন মাস বন্ধ থাকে।