কভিড মহামারির কারণে মানুষের আয় কমায় বৈষম্য বেড়েছে প্রায় সারাবিশ্বেই। আর দেশে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। যেহেতু মাথাপিছু আয় মানে হলো গড় আয়, সুতরাং এটি সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা দেখায় না। মাথাপিছু আয় বাড়লেই সব মানুষের আয় সমানভাবে বাড়বে, বিষয়টি তেমন নয়। যেহেতু এটি গড় হিসাব করে বের করা হয়, সুতরাং কারও আয় অনেক বাড়লেও মাথাপিছু আয় বাড়তে পারে। আর সেক্ষেত্রে মানুষ এই তথ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে নাও পেতে পারে। যেহেতু বৈষম্য বেড়েছে এবং সার্বিক দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, তাই অনেকে এই তথ্য তাদের নিজেদের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করছে।
অর্থনীতিবিদরা আয়বৈষম্য পরিমাপের ক্ষেত্রে জিনি সহগ ব্যবহার করে থাকেন। এর মান ০ থেকে ১ পর্যন্ত। যদি জিনি সহগের মান ০ হয়, তাহলে বুঝতে হবে, সেখানে আয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সমতা বিরাজ করছে, কারও কম বা কারও বেশি নয়। আবার যদি তার মান ১ হয়, তাহলে বুঝতে হবে সব সম্পদের মালিক একজন, বাদবাকিরা থাকবেন সম্পদবর্জিত। ১৯৭৩-৭৪ সালে আমাদের জিনি সহগ ছিল ০.৩৬ এবং তা পরবর্তী ১০ বছর ছিল একইরকম। ১৯৮৮-৮৯ সালে আয়বৈষম্য বাড়তে থাকলে সহগটির মান হয় ০.৩৮। ২০০৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ০.৪৭-এ এবং এ বৈষম্য অব্যাহত থাকায় ২০১৬ সালে তার মান দাঁড়ায় ০.৪৮-এ। এটা ভালো লক্ষণ নয়। সম্পদ গুটিকয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী ধনী ব্যক্তিদের পাঁচ শতাংশের হাতে চলে গেছে মোট জিডিপির ২৮ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশে দ্রুত হারে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে এবং এ ধনী ম্রেণির প্রবৃদ্ধির হার ১৭.৩ শতাংশ। গণমাধ্যম প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ব্যাংকের মোট আমানতের ১২ লাখ ১৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকার মধ্যে কোটিপতিদের আমানতই হচ্ছে ৪৩.৩৯ শতাংশ। মোট আমানতে কোটিপতিদের অংশীদারত্ব যে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। গত মে মাসে যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে যেসব দেশে স্বল্পসংখ্যক লোকের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে, এ রকম দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শীর্ষে।
গত ৫০ বছরে দেশে দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে কমেছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে বৈষম্যও বেড়েছে। বৈষম্য বেড়ে গেলে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচারও বেড়ে যায়। যেসব দেশের কর কম, সেসব দেশেই টাকা চলে যায়। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এখন রাজনৈতিক সমস্যা। সরকার জিডিপি বাড়ার যে দাবি করছে, সেইসঙ্গে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সে দাবি মিথ্যা হয়ে যায়। বাজার ব্যবস্থাপনায় তদারকির অভাব আছে এবং সরকারের আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এর ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। কভিড মহামারির আগে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ১৭ শতাংশ, নতুন করে বেকার হয়েছেন ১৩ শতাংশ মানুষ। মহামারির এই দুর্যোগে চাকরি বা কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হওয়া মানুষ মিলে এখন ছয় কোটির ওপর মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বিবেচনা করা হচ্ছে। কভিড মহামারিকে অনেকেই দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। কভিডের কারণে আয়বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। বিশেষত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তদের অনেকে নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়ায় সামাজিক বৈষম্য আগের চেয়ে অনেকাংশেই বেড়েছে।
কভিডের সময়ে অর্থনৈতিক শ্রেণি কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তবে অতি ধনী শ্রেণির ওপর এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশ এখন উচ্চ আয়বৈষম্য এবং বিপজ্জনক আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। ফলে মহামারিকালে গরিব আরও গরিব হচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিণত হচ্ছে নিম্নবিত্তে। এই বার্তা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নেতিবাচক। দেশে অসুস্থ ও অসম পুঁজির বিকাশ বন্ধ করতে হবে। আয়বৈষম্য, ধনবৈষম্য কমিয়ে আনতে হলে এর অন্য বিকল্প নেই। সুদূরপ্রসারী ভূমি সংস্কার ও কৃষি সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়নকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের তালিকার শীর্ষে রাখতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। স্থানীয় সরকারগুলোকে অধিকতর কার্যকর করে তুলতে হবে। এছাড়া অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কারের দিকে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান এই আয়বৈষম্য রোধে দ্রুত সক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি।
রাফিহা বিনতে মিজান
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়