ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক রিপন : বাংলাদেশের মৎস্য খাতের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় প্রকৃত পরিসংখ্যান সঠিকভাবে উপস্থাপনের অভাবে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। গত সপ্তাহে মাৎস্যবিজ্ঞানের স্নাতক পর্যায়ে সূচনা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের মৎস্য সেক্টরের অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক অবস্থা তুলে ধরার জন্য কিছু প্রশ্ন করলাম। উত্তরে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের কিছু পত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে বলল, বাংলাদেশ এ বছর চাষের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে বা মৎস্যচাষে পঞ্চম অবস্থান থেকে দুই ধাপ এগিয়ে বিশ্বে চাষের মাছে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, যা একটি মারাত্মক ভুল।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির পত্রিকা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড একোয়াকালচার-২০২২’ রিপোর্টের বরাত দিয়ে মৎস্যচাষে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়েছে এরকম একটি খবর প্রকাশ করেছে। শিক্ষার্থীরা পত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে কথা বলেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের শিক্ষক হিসেবে ভুল শুধরে দেয়ার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। তার পরও বৃহত্তর পরিসরে জনমনে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ক্ষুদ্র প্রয়াস হিসেবে এ লেখাটি লেখার চিন্তা অনুভব করলাম।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর জোড় বছরগুলোতে ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড একোয়াকালচার’ (সোফিয়া) শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। এটি হলো ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) ফিশারিজ ও একোয়াকালচার বিভাগের দ্বিবার্ষিক ফ্ল্যাগশিপ রিপোর্ট, যা বৈশ্বিক মাৎস্য সম্পদের মজুদের সার্বিক অবস্থার পাশাপাশি বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে ফিশারিজ ও একোয়াকালচারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনের প্রবণতার বিশ্লেষণ প্রকাশ করে।
সোফিয়া হলো জতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সরকার, নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজ এবং ফিশারিজ ও একোয়াকালচারে ক্ষেত্রে কর্মরত সব স্টেকহোল্ডারদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স। এই রেফারেন্স রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের সরকার মাছের উৎপাদন, মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ, অভ্যন্তরীণ বাজার ও রপ্তানি বাজারের বিকাশের জন্য গবেষণা এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেয়। সোফিয়া-২০২২ রিপোর্ট প্রকাশের প্রাক্কালে এ বছর জুন মাসের ২৯ তারিখে এফএও’র ওয়েবসাইটে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সম্পূর্ণ রিপোর্টটি এফএও আবার আগস্ট মাসের ১৯ তারিখে আপডেট করে।
সোফিয়া-২০২২ অনুযায়ী ফিশারিজ ও একোয়াকালচার পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান যথাক্রমে তৃতীয় ও পঞ্চম। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফিশারিজ ও একোয়াকালচার সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ফিশারিজ হচ্ছে, প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়ে (নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, উপসাগর, সাগর) মাছের বিচরণ ক্ষেত্র, খাদ্যাভ্যাস, প্রজনন, পরিযান ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে একটি টেকসই পন্থায় বছরের পর বছর মৎস্য আহরণ করা। যেমন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইলিশের প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করেছে এবং সে অনুযায়ী মৎস্য অধিদপ্তর বছরের নির্দিষ্ট সময় ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখায় পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের প্রাচুর্য ফিরে এসেছে। একে হিলশা ফিশারিজ বলা যায়। ফিশারিজ আবার অভ্যন্তরীণ জলাশয় ও সামুদ্রিক এ দুই ভাগে বিভক্ত। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় থেকে আহরিত মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীতে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও সামুদ্রিক জলাশয় থেকে আহরিত মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পিছিয়ে অর্থাৎ ২৫তম। অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে শীর্ষস্থানীয় মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছেÑভারত, চীন, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, উগান্ডা ইত্যাদি যেখানে বাংলাদেশের উৎপাদন ১.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। অন্যদিকে সামুদ্রিক জলাশয় থেকে আহরিত মাছ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো হচ্ছেÑচীন, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ইত্যাদি। বাংলাদেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের উৎপাদন ছিল ০.৬৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
অন্যদিকে একোয়াকালচার বলতে বদ্ধ জলাশয়ে (পুকুর, ধানক্ষেত, ঘের) কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ কর্তৃক মাছের পোনা মজুত, খাদ্য প্রয়োগ, রোগ পরিচর্যা ও নির্দিষ্ট সময় পর মৎস্য আহরণ করাকে বুঝায়। এভাবে পাঙাশের চাষকে পাঙাশিয়াস একোয়াকালচার বলা যায়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে একোয়াকালচার তথা মৎস্যচাষ ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। চাষকৃত মাছের মাধ্যমে বাংলাদেশে মোট মাছের উৎপাদন হচ্ছে ২.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে। চাষের মাছ উৎপাদনে যে দেশগুলো বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান করছে সেগুলো হচ্ছেÑচীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং এ দেশগুলোর উৎপাদন হচ্ছে যথাক্রমে ৪৯.৬, ৮.৬, ৫.২ এবং ৪.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। আয়তনের দিক থেকে ওই দেশগুলো বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বড়, যেমন চীন ও ভারত বাংলাদেশের তুলনায় যথাক্রমে ৬৪ গুণ এবং ২১ গুণ বড়, সে জন্য তাদের মোট উৎপাদনও বেশি। তাই চাষের মাছের উৎপাদন নিয়ে বাংলাদেশ কোন দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বা কোনো দেশকে পেছনে ফেলেছে, এরকম উদ্ভট তথ্য পরিবেশন করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। বরং বাংলাদেশ এত ছোট একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে আমরা যে পর্যায়ে পৌঁছেছি তা যথেষ্ট গর্বের বিষয়।
একোয়াকালচরের আরেকটি শাখা হচ্ছে মেরিকালচার বা সামুদ্রিক মৎস্যচাষ, যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বিকশিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হয়তোবা সামুদ্রিক উদ্ভিদ, সামুদ্রিক শৈবাল, শামুক জাতীয় প্রাণী, ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ ইত্যাদির মাধ্যমে মেরিকালচার বা সামুদ্রিক মৎস্যচাষ বিকশিত হবে।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো মৎস্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান যেসব শিরোনাম প্রকাশ করে থাকে সেগুলোর সঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তর বা এফএও’র রিপোর্টের শিরোনামের সঙ্গে কোনো মিল থাকে না। যেমন অনেক সময় খবরের শিরোনাম হয় ‘মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়’, যা একটি মারাত্মক ভুল। যেমন মিঠাপানির মাছ উৎপাদন এই শিরোনামে কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা অফিশিয়াল তথ্য-উপাত্ত পরিবেশন করে না। মৎস্য অধিদপ্তর তাদের এফআরএসএসের মাধ্যমে যেসব প্রধান শিরোনামে তথ্য পরিবেশন করে থাকে সেগুলো হচ্ছে ইনল্যান্ড ওপেন ওয়াটার (ক্যাপচার), ইনল্যান্ড ক্লোসড ওয়াটার (কালচার অথবা একোয়াকালচার), এবং মেরিন ফিশারিজ প্রডাকশন। এখানে ইনল্যান্ড ওপেন ওয়াটার (ক্যাপচার) বা অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে উৎপাদিত মৎস্য বলতে নদী, নদীর মোহনা, সুন্দরবন, বিল, কাপ্তাই লেক, প্লাবনভূমি, হাওর ইত্যাদি মুক্ত জলাশয়সমূহ থেকে আহরিত সামষ্টিক মৎস্য উৎপাদনকে বোঝায়। অন্যদিকে ইনল্যান্ড ক্লোসড ওয়াটার (কালচার অথবা একোয়াকালচার) বা বদ্ধ জলাশয়ে উৎপাদিত মৎস্য বলতে পুকুর, মৌসুমি জলাশয়, ধানক্ষেত, বাঁওড়, চিংড়ি ঘের, কাঁকড়া ঘের ও পেনে উৎপাদিত সামষ্টিক মাছের উৎপাদনকে বোঝায়।
অন্যদিকে মেরিন ফিশারিজ প্রডাকশন বা সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন বলতে সমুদ্র থেকে আহরিত মৎস্য উৎপাদনকে বোঝায়। এফএও ইনল্যান্ড ওয়াটার ক্যাপচার প্রডাকশন, একোয়াকালচার প্রডাকশন এবং মেরিন কেপচার প্রডাকশন শিরোনামে সারা পৃথিবীর মৎস্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান সন্নিবেশিত করে থাকে। এখানে মজার বিষয় হচ্ছে মৎস্য অধিদপ্তর এবং এফএও’র সন্নিবেশিত শিরোনামের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, এফএও বিভিন্ন দেশের সরকারি অর্থাৎ মৎস্য অধিদপ্তরের ডেটা নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে।
কিন্তু এসব বিজ্ঞানভিত্তিক শিরোনাম না বুঝে মিডিয়া যখন তাদের মনগড়া শিরোনাম দিয়ে খবর প্রকাশ করে তখন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এসব বিভ্রান্তিমূলক খবর প্রচারের পরও দায়িত্বশীল সূত্র থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না; ফলে ভুল ভুলই থেকে যায়, এই ভুল তথ্য দিয়েই বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আলোচনা চলতে থাকে। অনেক সভায় আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ধরনের ভুল শুধরানোর জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু একা বেশি কথা বলতে গেলে নিজেকে অন্যের বিরক্তির কারণ মনে হয়। তবে এসব ভুলের জন্য মিডিয়াকে সরাসরি দায়ী করা সঠিক হবে হবে না। বরং মৎস্য পরিসংখ্যান নিয়ে সংশ্লিষ্ট যেসব গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারি সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা দায়িত্বশীল পর্যায়ে কাজ করেন তাদের উচিত তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে জেনে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করা এবং মিডিয়াকে সহযোগিতা করা। এজন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এফএও প্রকাশিত সোফিয়া রিপোর্ট নিয়মিত চর্চা করা এবং রিপোর্টের তথ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাদান করা, গবেষণা করা এবং উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা করা।
অধ্যাপক, একোয়াকালচার বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়