রোহান রাজিব: উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আমানতের সুদহার কম ও ব্যাংকের ওপর আস্থাহীনতার কারণে ব্যাংকিং সেক্টরের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েই চলছে। গত এক বছরে ব্যাংক খাতের বাইরে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার ২১৯ কোটি টাকা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে মূল্যস্ফীতি চাপের কারণে ব্যাংক আমানতের বর্তমান সুদহারে টাকা রেখে লোকসান হচ্ছে। তাই তারা টাকা তুলে স্বর্ণ বা জমিতে বিনিয়োগ করছে। অন্যদিকে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। তাই মানুষের বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অনেক সঞ্চয় ভেঙে এ খরচ মেটাচ্ছেন। আবার কেউ সঞ্চয় করতে পারছেন না এ চাপের কারণে। তাই মানুষ আগের বছরের তুলনায় তাদের হাতে বেশি নগদ অর্থ রাখছে। এজন্য ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
তারা আরও বলেন, ব্যাংক খাতের ওপর বেড়ে চলা অবিশ্বাস, অন্যদিকে অবৈধ উৎস থেকে উপার্জিত অর্থ নিরাপদে রাখতে চাওয়াও ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বাড়ছে। দুর্নীতি ও অবৈধভাবে অর্জিত কালোটাকা ব্যাংক খাতে আসছে না। আবার বড় বড় কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা কমে আসায় মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে সিন্দুকে রাখছে। আবার প্রভাবশালীরা অবৈধ অর্থ হুন্ডির কাজে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর শেষে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ৩৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ অর্থ ৩০ হাজার ২১৯ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে সেপ্টেম্বরে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১২ লাখ ৫১ হাজার ১২০ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের অক্টোবরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬২ কোটি টাকা। এই সময়ে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এ বছরের অক্টোবরে তা আরও বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।
অক্টোবর শেষে ব্যাংকগুলোর ওয়েটেড গড় আমানতের হার দাঁড়ায় ৪ দশমিক শূন্য এক শতাংশ; যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৪.০৯ শতাংশ। যেখানে অক্টোবরে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮.৯৯ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে এ হার ৯.১০ শতাংশে ছিল। আর নভেম্বরে ৮.৮৫ শতাংশে। এ ছাড়া এক বছরের ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। চলতি বছরের অক্টোবরে এসে ঋণ ও বিল বেড়ে ১৪ লাখ ৩৪৫ কোটি টাকায় ওঠে। অর্থাৎ গত এক বছরে ঋণ ও বিল বেড়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে দ্বিতীয় প্রজšে§র একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি ও সিইও নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা এখন তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংক থেকে তাদের টাকা তুলে নিচ্ছেন; যা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে নগদ অর্থের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তহবিলের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
এদিকে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যও কমেছে। ২০২১ সালের অক্টোবর অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ২০ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অতিরিক্ত তারল্য কমে ১ লাখ ৭০ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ ১১ মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৫০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয় বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। তারা বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির বিভিন্ন সেবাও চালু হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো সেবাগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দিন দিন ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। কোনো টাকা যদি ব্যক্তির সিন্দুকে ঢুকে যায়, সে অর্থের উৎপাদনশীলতা থাকে না। এতে অর্থনৈতিকভাবে দেশ সংকটে পড়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, গত কয়েক মাসের অধিক মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের আমানতের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সঞ্চয় করার সক্ষমতা নেই। ব্যয় যতটা বেড়েছে, আয় ততটা বাড়েনি। তাই মানুষ সঞ্চয় থেকেও ভেঙে খাচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। তাই ব্যাংকিং সেক্টেরের বাইরে নগদ অর্থ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, যা অতিমাত্রায়। এমন একটি ব্যাংকের থেকে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, যেটা সবচেয়ে বড় একটি ব্যাংক। এসব ঘটনার কারণে ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। তাই ব্যাংকিং সেক্টরের বাইরে নগদ অর্থ বাড়ার এটাও অন্যতম কারণ।