কাজী সালমা সুলতানা: ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সহকর্মীদের সঙ্গে সদ্যমুক্ত যশোর পরিদর্শন করেন। সেদিন টাইমস পত্রিকার সংবাদে বলা হয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও পিপলস্ ডেমোক্রেটিক পার্টিকে বেআইনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হবে বলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যশোরে ঘোষণা করেন।
এদিন মুক্ত হয় ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট, জামালপুর, হিলি, বাহাদুরাবাদ, পিসপাড়া, দুর্গাদিঘি, বিলগ্রাম ও বাহাদুরাবাদ ঘাটসহ অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। বিভিন্ন গ্রামের শত শত পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে।
এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জোর দাবি জানায়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। সন্ধ্যায় বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এদিকে জামালপুর গ্যারিসনে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। অপরদিকে ময়মনসিংহে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা ত্যাগের ব্যবস্থা করতে সকালে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি ও পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করার জরুরি আবেদন জানান।
ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, যদিও পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধাবস্থা খুব ভালো নয়, তারপরও আমাদের আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় বেলা ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করে। হিলি সীমান্তে যৌথবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে রওনা হয়। মৌলভীবাজারের পতন আর নরসিংদীতে যৌথবাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধবিরতির জন্য মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জরুরি বার্তা পাঠান।
এদিন লে. জেনারেল নিয়াজি হঠাৎ ঢাকা বিমানবন্দরে হাজির হয়ে দম্ভভরে ঘোষণা করেন, তিনি পালিয়ে যাননি। তার মৃত্যুর আগে ঢাকার পতন হবে না।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৭১-এর দশ মাস