ভালো নেই রাজশাহীর রেশমচাষিরা

মেহেদী হাসান, রাজশাহী: ভালো নেই রাজশাহীর রেশমচাষিরা। জেলার বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জের বীজাগারের উৎপাদন কমে তলানিতে পৌঁছেছে। ফলে এখানকার রেশমচাষিরা বিপাকে পড়েছেন। আট-দশ বছর আগে ব্যাপকভাবে রেশম চাষের যৌবন শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা। তাই তালিকাভুক্ত শ্রমিকরা সারা মাস কাজ পাচ্ছেন না। মাসে ১৫ দিন কাজ করে ৪৫০ টাকা হাজিরা হিসেবে মজুরি নিতে হচ্ছে।

জানা গেছে, ১৮৬০ সালে ইংরেজদের উপজেলার মীরগঞ্জে নীল চাষের জন্য আগমন ঘটে। এই গ্রামে তারা গড়ে তোলে নীলকুঠি। আর আজও সেই নীল চাষের সাক্ষ্য বহন করছে উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী মীরগঞ্জ গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে শ্রমিকগোষ্ঠী ও কুঠির ধবংসাবশেষ নীলকুঠি।

তবে শোষকগোষ্ঠী ইংরেজদের পতন ঘটেছে অনেক আগে। তাদের শোষণের নানা স্মৃতিচিহ্ন আজও বহন করে চলছেন মীরগঞ্জ গ্রামের মানুষ। এ গ্রামে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি আজও ভোলেননি সাধারণ মানুষ। তবে এ নীলকুঠি বর্তমানে রেশম বীজাগার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

মীরগঞ্জ গ্রামের শ্রমিক আবদুর রহমান বলেন, একসময় এলাকার লোকজন জমিতে রেশম চারা উৎপাদন করতেন। বীজাগার থেকে ডিম এনে চাষ করতেন বাড়িতে। এখন তা আর হয় না। স্থানীয়রা রেশম চাষ করতে আগ্রহ হারিয়েছেন। যেটুকু হচ্ছে সরকারিভাবে। হারিয়ে যাচ্ছে বীজাগারের ঐতিহ্য। তাই কাজ কমে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছি।

মীরগঞ্জের তোয়ায়েল হোসেন বলেন, নীল চাষের সুবিধার্থে ইংরেজরা এই অঞ্চলের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটায়। নীলকররা বেশিরভাগ সময় ঘোড়ায় যাতায়াত ও চলাফেরা করত। ব্যাপক কষ্টদায়ক ও নির্যাতনমূলক নীল চাষ করতে কৃষকরা একপর্যায়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।

একসময় এ অঞ্চলে নীল চাষের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষকরা বিদ্রোহ করেন। ওই সময় হাজার হাজার কৃষক ইংরেজদের নীল চাষ বন্ধের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। পরে নীল কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতে নীলকররা নির্যাতনমূলক চাষ আবারও শুরু করে।

জানা যায়, ১৮৮৯ সালে মীরগঞ্জ নীলকুঠির আশপাশের গ্রামের কৃষক সংগঠিত হয়ে নীলচাষ বন্ধ করে দেন এবং নীলকুঠি আক্রমণ করেন। নীল চাষের জন্য নীলকররা এ অঞ্চলে অনেক যৌথ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল। ওইসব প্রতিষ্ঠানকে বলা হতো কনসার্ন। কনসার্নের অধীনে হাজার হাজার বিঘা জমি ছিল। ন্যায্যমূল্য না দেয়া ও বাধ্যতামূলক নীল চাষ করানোর প্রতিবাদে এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময় নীল চাষ করতে স্থানীয় লোকজন অনাগ্রহ প্রকাশ ও বিদ্রোহ করতে থাকলে নীলকররা আদিবাসীসহ ভারতের বিহার প্রদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত অধিবাসীদের এনে শ্রমিক হিসেবে নীলকুঠিতে নিয়ে আসে। তারা বুনো ও সাঁওতাল শ্রেণিভুক্ত। যেখানে নীলকুঠি ছিল, সেখানেই এ বুনো ও সাঁওতাল বসতি এখনও লক্ষ করা যায়।

এ এলাকার পাশের গ্রামে অর্ধশতাধিক সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন তখন থেকে বসবাস করে আসছে। বুনোরা দীর্ঘদিন ধরে এদেশে বসবাস করলেও তাদের আচার-আচরণ, হালচাল, সামাজিক কর্মপদ্ধতি, উচ্চারণ ভঙ্গি ও জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে তারা স্থানীয় নয়। তাদের মধ্যে এক শ্রেণি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। অপর শ্রেণি গাছ কাটা, মাটি কাটা ও শ্রমিকের কাজ করে। কঠিন ও পরিশ্রমী কাজ করতে তারা শারীরিকভাবে অসুবিধা বোধ করে না। তাদের অনেকে সাপ নিয়ে খেলা করত। মেয়ে-পুরুষ উভয়ে সমানভাবে কাজ করতে পারে। একটি অংশ সর্দার হিসেবে পরিচিত।

বাদুর, কাছিম, শিয়াল তাদের প্রিয় খাদ্য। তবে এখন তারা বাঙালিদের মতো চলাফেরা ও খাওয়াদাওয়া করে। বাঙালি হিন্দুদের মতো আচার-আচরণ করলেও সামাজিক ও কর্মপদ্ধতির দিক থেকে হিন্দুর সঙ্গে তাদের বেশ পার্থক্য রয়েছে। রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ঝাড়ফুঁক, গাছের ডাল, বাকল ও শিকড় দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে। তবে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে ওই চিকিৎসা। মীরগঞ্জ রেশম বীজাগারের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক আবদুল মালেক বলেন, এ বছর বীজাগারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দেড় লাখ ডিম, যা চারটি স্কিমে উৎপাদন করা হবে। ইংরেজদের শাসনামলে যে নীল চাষ করা হয়েছিল, সেই নীলগাছের নমুনা হিসেবে কয়েকটি গাছ রাখা হয়েছে। বর্তমানে নতুন প্রজšে§র সন্তানরা দেখতে আসে। স্থানীয়দের সহায়তা পেলে আগের মতো রেশম চাষের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। ভবনগুলো কালের সাক্ষী হয়ে আছে ইংরেজদের সেই নীল চাষ আর নীলকুঠির। তবে ১০০ বিঘা জমির ওপর বর্তমানে রেশম বীজাগার স্থাপন করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০