নজরুল ইসলাম: বাসা-বাড়িতে ব্যবহার্য এলপিজির দর নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন বিক্রেতারা। ইচ্ছামতো পকেট কাটছেন ভোক্তাদের। সরকারিভাবে দর নির্ধারণের আগেই অতিরিক্ত দর বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তৈরি করেছেন কৃত্রিম সংকট। রোজা শুরুর আগের মাসেই এমন পরিস্থিতি দেখে হতাশায় ভোক্তারা। ১২ কেজি এলপিজি ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পরিবেশকরা পণ্য সরবরাহ করছেন না। পরিবেশকরা বলছেন, কোম্পানি তাদের সরবরাহ করছে না।
যদিও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) কয়েকজন কর্মকতা জানিয়েছেন, কোনো সংকট নেই। সারাদেশে তাদের অভিযান শুরু হয়েছে।
গতকাল প্রতিকেজি এলপিজির দাম ১২৪ টাকা ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জানুয়ারি মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা, এখন তা বেড়ে হলো ১ হাজার ৪৯৮ টাকা। নতুন দাম গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকেই কার্যকর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ কয়েক দিন ধরে ১২ কেজির এলপিজি এক হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছিল।
ডিএনসিআরপি থেকে জানানো হয়েছে, আগামী রোববার পরিবেশকদের ডাকা হয়েছে। আর ভুক্তভোগীরা বলছেন আজ শুক্রবার ও শনিবার সরকারি দুই দিনের ছুটিতে ব্যবসায়ীরা ঠিকই ফায়দা লুটে নেবে।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা এক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘গোড়ায় হাত দিলেই তো হয়। কোম্পানি কত দরে পাইকারিতে দিচ্ছে, পাইকার কত দরে খুচরা বিক্রেতাকে দিচ্ছে, সেসব ভাউচার ধরে টান দিলেই তো হয়। কিন্তু, সেটা তো করা হচ্ছে না। যেটা আমরা আগেও দেখেছি।’
রাজধানীর বাংলামোটরে গতকাল বিকালে বসুন্ধরার ৪৫ কেজির এলপিজি সরবরাহ করা হয় একটি প্রতিষ্ঠানে। পিকআপে থাকা সরবরাহকারী জানান, আগে ৪৫ কেজির দর ছিল ৪ হাজার ৮৫০, এখন ৫ হাজার টাকা। এটা কোম্পানিরই দর। আর ১২ কেজির দর এক হাজার ৩৮০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের এক খুচরা বিক্রেতা জানান, তিনি পরিবেশক থেকে পাইকারি দরে ২৭ জানুয়ারি ৩৫ কেজির এলপিজি কিনেছেন চার হাজার ২০০ টাকায় আর ১২ কেজি কিনেছেন এক হাজার ৫০০ টাকায়। ৩০ জানুয়ারি ১২ কেজি কিনেছেন এক হাজার ৬৫০ টাকা। এক চা দোকানদার জানান, তিনি গতকাল সেনা ব্র্যান্ডের ১২ কেজির এলপিজি কিনেছেন এক হাজার ৭০০ টাকায়।
কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতারা জানান, তারা মগবাজারের এস এস এন্টারপ্রাইজ, কাঁঠালবাগানের জাহিদ এন্টারপ্রাইজ ও কারওয়ান বাজারের হক এন্টারপ্রাইজ থেকে পাইকারি দরে এলপিজি কেনেন। মূলত এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। তারা পণ্য থাকার পরও সরবরাহ করছে না। রসিদ দিচ্ছে না। রসিদ দেখাতে না পারায় তাদের জরিমানা করছে ডিএনসিআরপি।
কারওয়ান বাজারের এক খুচরা বিক্রেতা বলেন, ‘২৫ জানুয়ারি ১২ কেজির এলপিজির পাইকারি দর চলছিল এক হাজার ৩৮০ টাকা। কিন্তু, জাহিদ এন্টারপ্রাইজ আমার কাছে চেয়েছিল এক হাজার ৬০০ টাকা আর এসএস এন্টারপ্রাইজ চেয়েছিল এক হাজার ৬৫০ টাকা। পরে আমি অন্য জায়গা থেকে কিনেছি।’
মুগদা থানা এলাকার মান্ডার হিরু মিয়া রোডের আর্মি ভিলার দোকানদার নাইম বলেন, ‘সাড়ে ১২ কেজি এক হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করছেন। মালের সরবরাহ কম। তাই দাম বেশি।’
গতকাল কারওয়ান বাজারে অভিযান পরিচালনা করেন ডিএনসিআরপি’র সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘খুচরা বিক্রেতাদের কেন রসিদ দিচ্ছে না, সেটা জানাতে পরিবেশকদের আমরা আমাদের অফিসে ডেকেছি। রোববার তাদের আসতে বলা হয়েছে। খুচরা বিক্রেতার দায়িত্ব রসিদ রাখা। তাদের বলা হয়েছে, রসিদ রাখতে। পরিবেশকরা রসিদ না দিলে আমাদের জানাতে। কিন্তু, তারা জানায় না।’ তাহলে পরিবেশকদের দোকানে কি অভিযান চালানো হবে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা তো খুচরা বিক্রি করেন না। ভোক্তা যেখান থেকে পণ্য কিনবেন, আমরা সেখানেই অভিযান চালাব।’ বিইআরসি দর নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সেটা কোম্পানি কত দরে পরিবেশকের কাছে বিক্রি করছে, পরিবেশক খুচরা বিক্রেতাদের কাছে কত দরে বিক্রি করছে, এসব কে দেখবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমরাই দেখব। কিন্তু, আমাকে তো সেটা ট্রেস করতে হবে।’ ট্রেস তো আপনারা আগেও করেছেন, তাহলে এখন আবারও ট্রেস করতে হবে কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেজন্যই তো তাদের ডাকা হয়েছে। আর কোম্পানিগুলো তো আগেই বলেছে, তারা সরকারি দরের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করে না।’
এই বিষয়ে ডিএনসিআরপি’র পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সংকট নেই। বাজারে যাচ্ছে পর্যাপ্ত। এটা অজুহাত দেখিয়ে উচ্চমূল্য হাঁকানোর পাঁয়তারা। যে যার মতো পারছে দাম নিচ্ছে। আর খুচরা বিক্রেতারা অজুহাত দেখায় তাদের পরিবেশকরা কাগজ দেয় না। আমরা বলেছি পাকা রসিদ বাধ্যতামূলক। আমাদের অভিযান চলছে। পরিবেশকদের কার্যালয়েও অভিযান চালানো হবে। জেলা পর্যায়েও অভিযান শুরু হয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জাহিদ এন্টারপ্রাইজের জাহিদ বলেন, ‘আমি তো পরিবেশক না। আমি কারওয়ানবাজারে পণ্যই দিই না। আমার কাছে পণ্য নেই। আমি খুচরা বেচি।’ কারওয়ানবাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলছেন আপনি পণ্য লুকিয়ে রাখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব মিথ্যা কথা। আমার কাছে মালই নাই।’
অভিযোগের বিষয়ে হক এন্টারপ্রাইজের আবদুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘১২ কেজির গতকালে দর ১৫৭০-১৫৮০ টাকা পাইকারি। আমাদের কাছে যারা রসিদ চায় দিয়ে দিই। সর্বোচ্চ দর ১ হাজার ৫৮০ টাকা। যারা এক পিস নেয় তাদের কাছ থেকে ১৬০০ টাকা নিই। আমরা সিন্ডিকেট করছি না। অভিযোগের বিষয়ে এসএস এন্টারপ্রাইজের সেলিম বলেন, ‘কোম্পানিরই গ্যাস নেই। বসুন্ধরা, জি গ্যাস, ওরিয়নের গ্যাস নাই। টোটালের গাড়ি এক দিন থাকলে আরেকদিন নাই। আমদানি নাই। ১২ কেজি গতকাল আমাদেরই কেনা পড়েছে ১৬০০ ও ৪৫ কেজি ৫ হাজার ৬০০ টাকা। ২২ কেজি শুধু বেক্সিমকোর আছে। ভোক্তা অধিকার থেকে আমাকেও ফোন দিয়েছে। রোববার যেতে বলেছে।’