হুন্ডির জোয়ার থামাতে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স প্রবাহের হাত ধরেই আজকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ একটি সম্মানজনক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্সের অবদান মোট জিডিপির প্রায় ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক, বর্তমানে বাংলাদেশের নেট রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, গত মাস কয়েক আগেও বাংলাদেশের নেট রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা নি¤œ রেমিট্যান্স প্রবাহেরই ফল।

বিশ্লেষকরা তীব্র এই রিজার্ভ সংকটের জন্য করোনা ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করলেও মূলত এর নেপথ্যে রয়েছে হুন্ডি কারবারি। হুন্ডি মূলত  একটি অবৈধ, অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থা। দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা বিরাজমান ছিল। ধনী ও উন্নত দেশের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন ছিল না বলে বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি হয়ে আসত। ফলস্বরূপ, বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডার শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বৈদেশিক মুদ্রার এমন অবস্থা দূরীকরণে ওয়েজ আনার্স স্কিম প্রথা চালু করেন।

এতে হুন্ডির দাপট কমে গিয়ে দিনে দিনে বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পরে ওয়েজ আনার্স স্কিম প্রথা বন্ধ হলে জোরেশোরে হুন্ডির প্রকোপ বেড়ে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দিনের পর দিন যেন অবৈধ এই লেনদেন ব্যবস্থা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক জরিপে উঠে এসেছে, রেমিট্যান্সের মাত্র ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে, হুন্ডিতে আসে ৩০ শতাংশ। অনিরাপদ এ মাধ্যম ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য হওয়ায় প্রবাসীদের বড় একটি অংশ হুন্ডিতে ঝুঁকছে। ফলে তৈরি হচ্ছে ডলার সংকট, টান পড়ছে রিজার্ভে। দেশ ও জাতি বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে।  বড় প্রশ্ন হলো, কেন হুন্ডির এ জোয়ার?

ব্যাংকে হয়রানি, নি¤œ মানের ব্যাংকিং সেবা ইত্যাদি ঝামেলা এড়াতে বর্তমানে হুন্ডি অত্যাধিক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। মূলত হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বর্ধিত মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করতে থাকে। অন্যদিকে সরকার পাউন্ড, ডলারসহ সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ায় প্রবাসীরা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতে থাকে। উল্লেখ্য, গ্রামেগঞ্জে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা নেই, যা হুন্ডি বিকাশে সহায়ক। তাছাড়া বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংকিং সেবা নেই বললেই চলে, আছে শুধু আবেদন ও অনুমতির প্রশ্ন। অপরদিকে হুন্ডিতে লেনদেন একটা ফোনকলের ব্যাপার মাত্র। ইতোমধ্যেই লক্ষণীয় যে, সরকার দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রণোদনা সহায়তা ঘোষণায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহের নতুন রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে নতুন  নতুন পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। তাছাড়া হুন্ডি কারবারি বন্ধ করতে ওয়েজ আনার্স স্কিম পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারকে অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

হুন্ডির অনুরূপ সহজ ও দ্রুত সেবা ব্যাংকে কার্যকর করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলের ব্যাংকিং সেবা আরও জোরদার করার প্রচেষ্টা চালানো এখন সময়ের অন্যতম দাবি। তাছাড়া হুন্ডি দুর্বল করতে, হুন্ডির চেয়ে গতিশীল মাধ্যম এর ব্যবহার হতে পারে একটি সুদূরপ্রসারী ও টেকসই পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে রেমিট্যান্স প্রেরণ সহজ ও দ্রুততম করতে প্রতিটি এক্সচেঞ্জ হাউসকে অ্যাপ প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এছাড়া অর্থনীতির ক্যানসার হুন্ডির গতি থামাতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। এ ব্যাপারে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী দূতাবাসের ও তৎপর হওয়া উচিত। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হুন্ডি প্রতিরোধের পাশাপাশি দক্ষ  জনশক্তি রপ্তানিতে জোর দিতে হবে। হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসবে।

মোহাম্মদ আল-আমিন

শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০