মেহেদী হাসান, রাজশাহী:গাছে গাছে সোনালি মুকুলের মেলা। আগাম মুকুল যৌবন ফুরিয়ে কালো হতে শুরু করেছে। আম গাছগুলো যেন নতুন রূপে সেজেছে। পুরোনো গাছের কাণ্ডেও শীর্ষ ছাড়াও ডাল ফেটে বের হয়েছে মুকুল। এ শিশু মুকুলের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বুনছেন রাজশাহীর চাষিরা।
গাছে মুকুল আসার আগ থেকেই পরিচর্যা শুরু হয় আমচাষিদের। মুকুলের পর সবুজ গুটিগুলো যেন আম চাষির অন্যতম ভরসার জায়গা দখল করে। গুটি যত বড় হয় ততই বাড়ে চাষির মনের আনন্দ। চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভালো ফলনের আশা করছেন তারা। নতুন করে গত বছর থেকে জেলার বাগমারা, দুর্গাপুর ও গোদাগাড়ী এলাকায় আমের চাষ সম্প্র্রসারিত হয়েছে। ফলে উৎপাদন বাড়বে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কৃষকরা বলছেন, কৃষি বিভাগের পরামর্শে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। আশা করছেন, বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমের বাম্পার ফলন হবে। গাছে গুটি আসার আগে থেকেই গাছগুলোর পরিচর্যা এবং পরামর্শ অনুযায়ী মুকুল আসার পর থেকে বিভিন্ন রোগবালাই দমনের ব্যবস্থা করতে হয়। কিছু গাছের মুুকুল ঝরে গিয়ে মোটর দানায় রূপ নিয়েছে আম।
রাজশাহী কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার রাজশাহী জেলায় ১৮ হাজার ৫৯১ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। গত বছর চাষ হয়েছিল ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে। সেই হিসাবে চাষের এলাকা বেড়েছে ৭৬ হেক্টর। গত বছর এ জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। এবার সেখানে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ২৩ মেট্রিক টন। যদিও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমি। এর আগে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমি। গত তিন বছরের তুলনায় এবার বেড়েছে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা। প্রতি হেক্টরে ১১ দশমিক ১৩৬ মেট্রিক টন ফলন ধরা হয়েছে। এবার রাজশাহীতে হাজার কোটি টাকার আমের ব্যবসা হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
সেই সঙ্গে চাষিদের প্রয়োজনমতো পরামর্শ প্রদান করছেন কৃষি বিভাগ। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা উম্মে ছালমা বলেন, এবার আবহাওয়া ভালো আছে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও আমরা নিয়মিত চাষিদেও পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকছি। রাজশাহীর কৃষক আম চাষে অভ্যস্ত। তারা পোকা বা ছত্রাকজনিত বিভিন্ন সমস্যায় বালাইনাশক প্রয়োগ করে এবং করছে। সামনে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে আমের বাম্পার ফলনের আশা করা হচ্ছে।
আম চাষের পরামর্শ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রিভেন্টিভ হিসেবে ডিসেম্বর মাসে (মুকুলের রস চুষে খাওয়া) হপার পোকার জন্য ইমিটাক্লোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে বলা হয়। মুকুল বের হওয়ার আগে বা গুটি মটর দানার মতো হলে ম্যানকোজেব এবং মুকুল যদি কালো হয়ে আসে বা দাগ দেখা যায় তাহলে ট্রুপার জাতীয় বালাইনাশক ব্যবহার করতে পরামর্শ দেয়া হয়। সবকিছু মিলিয়ে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় আড়াইশ জাতের আম উৎপন্ন হয়। এগুলোর মধ্যে এ বছর ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাতি, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, লখনা ও মোহনভোগ জাতের আমের চাষ বেশি হয়েছে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন জানান, চলতি মৌসুমে আমের মুকুল বেশি হয়েছে। সাধারণত আমগাছে মুকুল আসার পর হপার পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী পোকা মারা কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেছেন চাষিরা। ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাক নাশক এবং ইমিটাক্লোপিড জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে (ম্যানকোজেব ২ গ্রাম ও ০.৫ মিলি ইমিটাক্লোপিড) তিন বার স্প্রে করার পরামর্শ দেয়া হয়। একবার মুকুল আসার আগে, মুকুল ফোটার আগে এবং আম মোটর দানার মতো হলে। রাজশাহীর আমচাষিরা আগে থেকেই যেহেতু অভিজ্ঞ সেহেতু তারা খুব সহজেই আমের যতœ নিতে পারেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
রাজশাহীর সবকটি উপজেলায়ই আম চাষ হয়। ৯টি উপজেলার বাঘায় সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয়। এখন আমের বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন আমচাষিরা। বাঘার পাকুড়িয়া এলাকার চাষি আরমান হোসেন জানান, এ বছর আমের বাগানে একটু কম মুুকুল ভালোই রয়েছে। যারা বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ করে তাদের বাগানে ভালো মুকুল আছে। সামনে আবার কালবৈশাখী ঝড় আছে। ঝড়ের পর আসলে বোঝা যাবে কী হবে। এত আগেই কিছু বলা যাবে না। তারপরও আশা ছাড়ছি না।
পবা উপজেলার আম ব্যবসায়ী ও আমচাষি মোর্তজা আহম্মেদ জানান, আমি প্রতি বছরই আম চাষ করি। এবারও আশা করি ভালো ফলন হবে। আমরা চাষিরা মুকুল আসার আগে থেকেই গাছের পরিচর্যা করছি। তবে, ১৫শ টাকা টিএসপি সার এবার দ্বিগুণ দামে কিনতে হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, এবার আমের মুকুল বেশ ভালো হয়েছে। রাজশাহীর কৃষকরা আমের পরিচর্যা জানে। কৃষি বিভাগ থেকে সব সময় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আমরা মাঠ পরিদর্শন করছি এবং কৃষকদের বক্তব্য অনুযায়ী পরামর্শ দিচ্ছি।