রোহান রাজিব: ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালায় শিথিলতা আনার পর অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ। ২০২২ সালে ব্যাংক খাতে ২৯ হাজার ২৭৯ কোটি ৮২ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। ২০২১ সালে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৩৭৯ কোটি ২৬ টাকা। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ১৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল বেশি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
পুনঃতফসিল ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতাকে দায় করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের শিথিলতার আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে হলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো। এখন তা আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ জমা দিলেই করা যাচ্ছে। আগে এসব ঋণ পরিশোধের সময় ছিল সর্বোচ্চ দুই বছর। এখন ৫ থেকে ৮ বছর সময় পাচ্ছে। এছাড়া আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। এখন সেই ক্ষমতা পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তাই বোর্ড গ্রাহককে ইচ্ছেমতো সুবিধা দিয়ে পুনঃতফসিল করার সুযোগ দিয়েছে। এজন্য ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিকভাবে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের ১৮ জুলাই পুনঃতফসিল নীতিমালায় শিথিলতা আনার পর বছরের শেষ ছয় মাসে অস্বাভাবিক চিত্র দেখা যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুনÑএ ছয় মাসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় পাঁচ হাজার ৯৬০ কোটি ৪৫ লাখ টাকার। শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২৩ হাজার ৩১৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা পুনঃতফসিল করা হয়। ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এর পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।
এছাড়া গত বছরের শেষ প্রান্তিকের চিত্রটি আরও অস্বাভিবক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) যা ছিল ৫ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। ২০২১ সালের শেষে প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। এতেই বোঝা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতার পর অস্বাভাবিকভাবে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ বেড়ে চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়ের কারণে কভিডকালে কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি হতো না। এখন যেহেতু সুবিধা উঠে গেছে, তাই ঋণ খেলাপি না হতে পুনঃতফসিলে ঝুঁকছে। এছাড়া খেলাপি থেকে বের হয়ে নতুন করে ঋণ পাওয়ার জন্য পুনঃতফসিল করছে। তাই অস্বাভাবিকভাবে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ বেড়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালায় শিথিল আনার পর গ্রাহকদের এ সুবিধা বেশি দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। কারণ ব্যাংকগুলোর বোর্ডের হাতেই পুরো ক্ষমতা দেয়া আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমতি নিতে হয় না। যদি ব্যাংকগুলোর বোর্ড ভালো হলে এ সমস্যা হতো না। তখন যাচাই-বাছাই করেই পুনঃতফসিল করত তারা। এখন যেভাবে পুনঃতফসিল করা হচ্ছে, এটা ব্যাংকের জন্য ক্ষতি। এখানে গ্রাহক সুবিধা পাচ্ছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও কঠোর হওয়া উচিত।
এদিকে পুনঃতফসিল ঋণ বাড়ার সঙ্গে সুদ মওকুফের পরিমাণও বেড়েছে। ২০২১ সালে ১২ হাজার ৩৭৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা পুনঃতফসিল করা ঋণের বিপরীতে এক হাজার ৮৫৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করা হয়। ২০২২ সালে ২৯ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা পুনঃতফসিল ঋণের বিপরীতে করা হয় ৫ হাজার ৫৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সুদ মওকুফ বেড়েছে ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ১ হাজার ৮৯৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এর আগের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এর পরিমাণ ছিল ৩৫০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
ব্যাংকাররা বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কম দেখানোর জন্য বিভিন্নভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ছাড় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ করে করোনার প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালে কেউ কোনো টাকা না দিলেও তাকে খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে একজন গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, কেউ ১৫ শতাংশ দিলে তাকে আর খেলাপি করা হয়নি। এর আগে ২০১৯ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য বিপুল পরিমাণের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। তার আগে ৫০০ কোটি টাকার বড় অঙ্কের ঋণ পুনর্গঠন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিলসহ বিভিন্ন শিথিলতা দেয়া হয়। বারবার এরকম শিথিলতার কারণে গ্রাহকদের কেউ কেউ ঋণ পরিশোধের চেয়ে সুবিধা নেয়ার পেছনে ছুটছেন বেশি। আর এসব ছাড়ের কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকায়। ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণস্থিতির যা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, দেশে নথিপত্রে খেলাপি ঋণ যতই দেখানো হোক না কেন, প্রকৃত চিত্র তার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। অনেক গ্রুপের ঋণ আদায় না হলেও বছরের পর বছর খেলাপি করা হয় না। আবার একই ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে ঋণ নিয়মিত রাখা হয়।
শিথিলতার পর অস্বাভাবিক বেড়েছে পুনঃতফসিলি ঋণ
