বন্যায় তলিয়ে গেছে ২০ জেলা পানি বাড়ছে ঢাকার আশেপাশে

নিজস্ব প্রতিবেদক : উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে  নেমে আসা ঢলে পানি বাড়ার কারণে তলিয়ে গেছে ২০টি জেলা। এর অধিকাংশই উত্তরের। এছাড়া গত দুদিনে বন্যায় ভেঙে গেছে বেশ কয়েকটি নদী রক্ষা বাঁধ।

এদিকে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানিও বাড়তে শুরু করেছে। তবে তা এখনও বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, টঙ্গী খাল, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গার পানি সর্বোচ্চ ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়েছে। এসব নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হলেও আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে তা বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ  কেন্দ্র।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই বর্ষায় সারা দেশে দ্বিতীয় দফা বন্যাকবলিত ২০টি জেলার মধ্যে অধিকাংশ জেলাই উত্তরাঞ্চলের। মোট ছয় লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি হয়ে দুর্দশার মধ্যে রয়েছে।

এ অঞ্চলের পানি নামার সময় মধ্যাঞ্চলকে বন্যায় ভাসাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উত্তরের পানি মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাবে বলে মধ্যাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়েছিল বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র। সেক্ষেত্রে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বুড়িগঙ্গার পানি ঢাকা পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। ডেমরায় বালু নদীর পানি ১২ সেন্টিমিটার, শীতলক্ষ্যার পানি নারায়ণগঞ্জে ১১ সেন্টিমিটার, মিরপুরে তুরাগ নদীর পানি আট সেন্টিমিটার, টঙ্গী পয়েন্টে টঙ্গী খালের পানি পাঁচ সেন্টিমিটার  বেড়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি আগামী ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকবে। গতকাল পর্যন্ত পানি পর্যবেক্ষণের ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৬টি পয়েন্টে এবং হ্রাস পেয়েছে ৩২টি পয়েন্টে। এর মধ্যে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ৩০টি পয়েন্টে। অপরিবর্তিত একটি ও তথ্য পাওয়া যায়নি একটি পয়েন্টের। এর মধ্যে যমুনার কাজিপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার সবচেয়ে বেশি ওপর দিয়ে (১৩৫ সেন্টিমিটার) প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস  পেয়েছে।

এদিকে নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা। ছোট যমুনা নদীর ফ্লাড ওয়ালের আউটলেট দিয়ে পানি প্রবেশের ফলে নওগাঁ শহরের কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শহরের বন্যা প্লাবিত মহল্লাগুলোর রাস্তাসহ বাড়িঘরে পানি ঢুকে যাওয়ায় এসব এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমারে তিনটি নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। এ জেলার ৯টি উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এ নদীর সংযোগ নদী ‘বাঙ্গালী’র পানিও বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ‘বাঙ্গালী’ নদী সংলগ্ন এ জেলার তিনটি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

তবে নীলফামারী জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানানো হয়। মঙ্গলবার তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

তবে বগুড়া জেলায় বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় হুমকিতে পড়েছে দুটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এদিকে তিন উপজেলার ৮২টি বিদ্যালয়ে পানি উঠায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার অন্তত ১০টি পয়েন্টে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়ে পানি  ভেতরের অংশে প্রবেশ করছে। গতকাল বিকালে যমুনার পানি বিপৎসীমার ১২০  সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

অন্যদিকে যমুনার সঙ্গে ‘বাঙ্গালী’ নদীর পানি বাড়ায় দুই নদীর নিন্মাঞ্চলের এলাকাগুলো এখন প্লাবিত। বন্যার্ত ও বাঁধের ওপরসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া  লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। সার্বিকভাবে বগুড়ার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

বন্যাকবলিত সারিয়াকান্দির কুতুবপুর, দীঘলকান্দি, চন্দনবাইশা ও ধুনটের পুকুরিয়া ভাণ্ডারবাড়ি, বড়ইতলী, বানিয়াজান, শিমুলবাড়ি ও আটাচর এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নিচ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব স্থানে বালির বস্তা ও পাইলিং করে মেরামত করছে। এরপরও বাঁধ-সংলগ্ন এলাকাগুলোর লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েই চলছে।

বগুড়া পানি উন্নয়নের বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশরী রুহুল আমিন যমুনার পানি বৃদ্ধির কারণে বাঁধ ঝুঁকির মুখে পড়ার কথা স্বীকার করে তিনি জানান, কিছু সমস্যা থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।

ওই জেলার ত্রাণ কর্মকর্তা শাহারুল হোসেন মো. আবু হেনা জানিয়েছেন, জেলার বন্যাকবলিত তিন উপজেলা সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে রয়েছে।

গত সোমবার বিকালে সারিয়াকান্দিতে বাঁধ পরিদর্শন করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন বগুড়া জেলা প্রশাসক  মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী।

এদিকে বগুড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ দুই লাখ টাকা ও ১০০ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দি বন্যাদুর্গত এলাকায় গত সোমবার নগদ এক লাখ টাকা ও ৫০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যাকবলিত দুটি উপজেলা  সোনাতলায় ৫০ হাজার টাকা ও ৩০ টন চাল এবং ধুনটে ৫০ হাজার টাকা ও ২০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ধরলা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরবর্তিত রয়েছে। তিস্তা ও ধরলা নদী বন্যায় লালমনিরহাট জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার এক লাখ ২০০ পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে সদর উপজেলার মোগলহাট ও কুলাঘাট ইউনিয়নের ধরলা নদীর তীরবর্তী চারটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

নওগাঁয় প্রধান দুই নদীর পানি আরও বৃদ্ধি হওয়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। একটি সড়ক ভেঙে যাওয়ায় আত্রাই উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শহরের নতুনভাবে রাস্তায় পানি উঠেছে। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নওগাঁ শহরের হাসপাতাল সড়ক, মুক্তির মোড় থেকে কাজির মোড় পর্যন্ত প্রধান সড়ক জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় আত্রাই নদীর পানি ২৩ সেন্টিমিটার  বেড়ে গিয়ে এখন বিপৎসীমার ১২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ছোট যমুনা নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

রানীনগর উপজেলার বেতগাড়ির সন্নিকটে আত্রাই-নওগাঁ সড়ক ভেঙে যাওয়ায়  সেদিক দিয়ে যমুনা নদীর পানি রানীনগর ও আত্রাই উপজেলার পূর্বাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে। এতে আত্রাই উপজেলার তিনটি এবং রানীনগর উপজেলার চারটি ইউনিয়নে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। আত্রাই উপজেলার সঙ্গে নওগাঁ জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে নীলফামারী জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ডিমলা উপজেলার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০  সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত রোববার ওই পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল।

তবে অনেকের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদিকে পানির তোড়ে ভেঙে পড়েছে তিস্তাপাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের ছোট খাতা ও বাইশপুকুর গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার এখনও পানিবন্দি রয়েছে বলে জানান এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা। ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামে তিস্তার গাইড বাঁধ ভাঙার কারণে গ্রামের ৪০ পরিবার তিস্তার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যারাজের ভাটিতে ইউনিয়নের বাইশপুকুর গ্রামে  স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধের সংযোগ বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় সেখানকার প্রায় ৮০০ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে বলে ওই ইউনিয়ন পরিষদেও চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, মঙ্গলবার তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত রোববার ওই পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। সোমবার থেকে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ জরুরি মেরামতের প্রক্রিয়া চলছে। বাঁধগুলো মেরামত করা না হলে আবারও বন্যার পানি এলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০