স্ত্রীর মাথা ফাটিয়ে শ্রীঘরে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ১৩ বছর আগে বিয়ে করেছেন। সেই ঘরে রয়েছে ৫ ও ৯ বছরের ফুটফুটে দুটি কন্যাসন্তান। স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও হয়ে পড়েন পরনারীতে আসক্ত। দুই নিষ্পাপ সন্তানের কথাও ভাবলেন না। তার ওপর প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই করলেন দ্বিতীয় বিয়ে। স্ত্রী-সন্তানকে ঠিকমতো ভরণপোষণ তো দেনই না। প্রতিবাদ করলে চলে নির্যাতন। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়াবাসায় থাকেন। প্রথম স্ত্রী ও তার সন্তান সেই বাসায় প্রবেশ করার পরই রড দিয়ে স্ত্রীকে পেটালেন। ফাটালেন মাথা। মাকে বাঁচাতে এলে নিজের মেয়েকে ছুরি দিয়ে জখম করলেন। সৈয়দ নাছির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।

তিনি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) হিসেবে ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটে কর্মরত রয়েছেন। তবে স্ত্রীর করা মামলায় বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। নির্যাতনের বিচার চেয়ে প্রথম স্ত্রী তহমিনা খানম এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছেন; যার সঙ্গে নির্যাতনের প্রমাণ দেয়া হয়েছে। আবেদনের একটি কপি এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তহমিনা খানমের অভিযোগ, ‘এই কর্মকর্তা উপার্জিত সব অর্থ ভগ্নিপতি মো. শাহাদাত হোসেন সাবুর ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। ভগ্নিপতির যন্ত্রণায় স্ত্রী ও সন্তানকে ভরণপোষণ দিতেন না। আমাকে তালাক দিতে পরামর্শ দিতেন।’

এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেয়া তহমিনা খানমের আবেদনে বলা হয়েছে, পারিবারিকভাবে ২০১০ সালের ১৮ জুন সৈয়দ নাছির উদ্দিনের সঙ্গে তহমিনা

 খানমের বিয়ে হয়। ১২ বছর সংসার জীবনে তাদের দুটি কন্যা রয়েছেন। বড় মেয়ে সৈয়দা নুসরাত সুলতানা নাবিলার বয়স ৯ বছর ও ছোট মেয়ে সৈয়দা নাফিয়া তাবাচ্ছুমের বয়স ৫ বছর। বিয়ের পর তাদের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু নাছির উদ্দিন পরনারীতে আসক্ত হয়ে পড়েন। প্রথম স্ত্রীকে

বাবার বাড়ি থেকে ১০ লাখ টাকা যৌতুক এনে দিতে চাপ দিতেন। এই নিয়ে প্রতিবাদ করায় বিভিন্ন সময় তহমিনা ও তার সন্তানদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন তিনি। এরই মধ্যে ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট নাছির উদ্দিন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আফরিন সুলতানাকে বিয়ে করেন। আইন অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিয়ে করতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু নাছির উদ্দিন প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেননি।

আরও বলা হয়, দ্বিতীয় বিয়ের পর তহমিনা খানম ও তার দুই মেয়ের ভরণপোষণ দিতেন না নাছির উদ্দিন। তহমিনা বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে সংসার চালাতেন ও মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দিতেন। টাকা চাইতে গেলে তহমিনা ও তার সন্তানদের নির্যাতন করতেন নাছির। বলতেন, বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে চলতে না পারলে সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যাও। দ্বিতীয় স্ত্রী আফরিনকে নিয়ে নাছির উদ্দিন রাজধানীর আদাবর থানার মুনসুরাবাদ আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। ২৪ মার্চ তহমিনা ও তার মেয়ে গোপালগঞ্জ থেকে নাছির উদ্দিনের ঢাকার বাসায় যায়। নাছির তাদের বাসায় প্রবেশে বাধা দেন। যৌতুকের ১০ লাখ টাকা এনেছে কি না; জিজ্ঞাসা করেন। এই নিয়ে তহমিনা ও নাছির উদ্দিনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে নাছির ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী আফরিন সুলতানাসহ তাদের কয়েকজন আত্মীয় মিলে তহমিনাকে লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারপিট। এতে তহমিনার মাথা পেটে যায়। মেয়ে বাঁচাতে গেলে ছুরি দিয়ে তাকে জখম করে। পরে তিনি বাসার একটি রুমে ঢুকে ৯৯৯-ফোন দিলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। আহত তহমিনা ও মেয়েকে শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে তহমিনা বাদী হয়ে নাছির উদ্দিন ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী আফরিন সুলতানা, নাছিরের ভগ্নিপতি শাহাদাত হোসেন সাবুসহ ১০ জনকে আসামি করে ২৬ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে আদাবর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার পর ২৭ মার্চ সৈয়দ নাছির উদ্দিন এজাহারভুক্ত কয়েকজনকে আটক করা হয়। পরে আদালত নাছির উদ্দিনকে জেল হাজতে প্রেরণ করেন।

আবেদনপত্রে তহমিনা অভিযোগ করেন, সৈয়দ নাছির উদ্দিনের বড় ভগ্নিপতি শাহাদাত হোসেন সাবু ও সাবুর স্ত্রী তহমিনার সংসার ভাঙার পেছনে কলকাঠি নাড়েন। তহমিনাকে সংসার থেকে বিতাড়িত করতে নাছিরকে দীর্ঘদিন ধরে প্ররোচনা দিয়ে আসছেন সাবু ও তার স্ত্রী। সাবুর নড়াইলের লোহাগড়ায় ছোট্ট একটা রড সিমেন্টের দোকান ছিল। নাছির উদ্দিন তার উপার্জিত প্রায় দুই কোটি টাকা বিভিন্ন সময় সাবুর ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। সেই টাকা দিয়ে সাবু হামদান পরিবহন নামে একটি বাস ও কয়েকটি ট্রাক কিনেছেন। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে ভরণপোষণ না দিয়ে এই টাকা বিনিয়োগ করেছেন। স্ত্রী, সন্তানকে নির্যাতনকারী সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ নাছির উদ্দিনকে সরকারি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা হয়।

এই বিষয়ে গতকাল বিকালে তহমিনা খানম শেয়ার বিজকে বলেন, মামলায় নাছির ছাড়া সবার জামিন হয়ে গেছে। মামলা না নিতে ফোন করা হয়েছে। বলেছে, নিজেরা বসে মীমাংসা করবেন। অভিযোগ করে তিনি বলেন, কালকে আমাদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেয়া হয়েছে যে বাড়িতে কে কে রয়েছেন। সাবু এই লোক পাঠিয়েছেন। নাছির যৌতুক চাইতেন, ভরণপোষণ দিতেন না।

অন্যদিকে, অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করেন সৈয়দ নাছির উদ্দিনের ভগ্নিপতি শাহাদাত হোসেন সাবু। নাছির উদ্দিন তার উপার্জিত প্রায় দুই কোটি আপনার ব্যবসায় লগ্নি করেছেনÑএমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন জাপানে ছিলাম। ১২ বছর সেখানে থেকে পয়সা-কড়ি কামিয়েছি। আমার যে সম্পদ সব জাপানে থেকে করা। নাছির আমার শ্যালক। তবে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল না। কারও টাকা আমি স্পর্শ করি না। আমার ব্যাংকের লোন আছে। সেই লোনের টাকায় আমি ব্যবসা করি। নাছিরের দুই টাকাও আমি স্পর্শ করি নাই। তার টাকার বিষয়ে জানিও না। দুই কোটি টাকা সে পাবে কোথায়?’ আপনার প্ররোচনায় প্রথম স্ত্রী-সন্তানের ওপর নির্যাতন করা হতো, ভরণপোষণ দেয়া হতো নাÑএমন অভিযোগের বিষয়ে সাবু বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে জানি না। আমি থাকি লোহাগড়ায়।’ স্ত্রীর মাথা ফাটানো ও সন্তানকে ছুরি মারার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না।’

অপরদিকে, সৈয়দ নাছির উদ্দিনের স্ত্রী তহমিনা খানম নির্যাতনের বিচার চেয়ে ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটে আবেদন করেছেন। এই বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি নাÑ এমন বক্তব্য জানতে ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনার মোবারা খানমকে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ নাছির উদ্দিন জেল হাজতে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০