বহুজাতিক কোম্পানি কূটকৌশলে বাড়াচ্ছে ই-সিগারেট

নিজস্ব প্রতিবেদক:‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য ব্যাহত করতে তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কূটকৌশল প্রয়োগ করে দেশে ই-সিগারেটের বাজার দ্রুত সম্প্রসারণ করছে। ই-সিগারেট গ্রাহকদের বেশিরভাগ যুবক, বিশেষ করে ছাত্র। তথাকথিত ইতিবাচক তুলে ধরে তরুণদের ই-সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। ফলে কখনও ধূমপান করেনিÑ এমন তরুণ-যুবকের অনেকেই ই-সিগারেটের প্রতি অভ্যস্ত করতে তামাক কোম্পানিগুলো এবং তাদের সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করছে।

এক সেমিনারে এ-সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এ সেমিনারের আয়োজন করে ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্ক-আইপিএন।

‘বাংলাদেশে নতুন পণ্য বিস্তারে তামাক শিল্পের কূটকৌশল’ শীর্ষক গবেষণাটি যৌথভাবে সম্পাদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী এহসানুল হক জসীম ও তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক সৈয়দ সাইফুল আলম। ছয় মাসব্যাপী মাঠ পর্যায়ের এ গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২০২২ সালে। ফল উপস্থাপনে বলা হয়, ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথম ই-সিগারেট আগমনের পর প্রথম ৪ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত শুধুই রাজধানীর কিছু অভিজাত এলাকায় ই-সিগারেটের অল্প কিছু দোকান ছিল। ই-স্মোকারের সংখ্যাও তখন কম ছিল। এখন সারাদেশে ই-সিগারেট পাওয়া যায়। জ্যামিতিকহারে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ই-স্মোকারের সংখ্যা, ই-সিগারেটের ব্যবহার।

সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে চালু হয়েছে এবং এখনও ই-সিগারেট বিক্রি করছেÑএমন দোকানের সংখ্যা ২২ শতাংশ। বাকি ৭৮ শতাংশ ই-সিগারেটের দোকান ২০১৬ সালের পর (২০১৭-২০২১) পাঁচ বছরের মধ্যে চালু হয়। মাত্র পাঁচ বছরে কয়েকগুণ ভ্যাপিং শপ বৃদ্ধি পেলেও পুরোনো দোকানগুলোর বিক্রি কমেনি; বরং নতুন ও পুরাতন দোকানগুলোয় দিন দিন বিক্রি বাড়ছে। মাত্র কয়েক বছরে বেশিরভাগ ই-সিগারেটের দোকান চালু হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ই-সিগারেট খুবই দ্রুত ও আশঙ্কাজনক হারে বিস্তারের প্রমাণ। তামাক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন কূটকৌশলের কারণে বাংলাদেশে ই-সিগারেটের ব্যবহার ও নতুন এ তামাক পণ্যের বাজার জ্যামিতিক হারে বিস্তৃত হচ্ছে।

গবেষণা ও অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমেরিকার টোব্যাকোসহ (বিএটি) বিভিন্ন বহুজাতিক তামাক কোম্পানি বাংলাদেশ ই-সিগারেট বিস্তারে কাজ করছে। জনসংখ্যার অনুপাতে গত কয়েক বছরে দেশে প্রচলিত ধূমপায়ীর হার কমেছে। কিন্তু বহুজাতিক বিভিন্ন তামাক কোম্পানির কৌশল এবং প্রচারমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে ই-সিগারেট এখন তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে এ গবেষণায়। ই-সিগারেটের বাজার সম্প্রসারণ রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের (এনটিসিসি) অধীনে একটি পৃথক বিভাগ গঠনের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলোর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠনের প্রতিনিধি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য দেন।

সেমিনারের প্যানেল আলোচক মানসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বারডেমের ডেন্টাল বিভাগের প্রধান বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, অনেক তরুণ-তরুণী প্রথমে ই-সিগারেট গ্রহণ করে, পরে ইয়াবা, হিরোইন, কোকেইন প্রভৃতি মাদকে ঝুঁকছে। আইনের মাধ্যমে ই-সিগারেট বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত সংশোধন করতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দীন আহমদ বলেন, ই-সিগারেটের মতো ক্ষতিকর তামাক পণ্য আমদানির অনুমোদন দেয়া যাবে না।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দীন ফারুক বলেন, ই-সিগারেট ব্যবহারের ফলে তরুণরা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তরুণ প্রজš§কে ই-সিগারেটের ভয়াবহতা থেকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের ছেলেময়েদের এসব ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। একটা ভঙ্গুর জাতি তৈরির জন্য বিদেশি বেনিয়া কোম্পানিগুলো সুকৌশলে এসব কাজ করছে, তা বুঝতে আমরা দেরি করে ফেলছি।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, তরুণদের ধ্বংস করার ভয়ংকর উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে ই-সিগারেটের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে; এই ভয়ংকর তামাক পণ্য এখনই থামাতে হবে। ধূমপানের কারণে পরিবেশ দূষণও হচ্ছে। যেসব কোম্পানি এসব পণ্য তৈরি করছে, তারাই আবার বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আধিপত্য বিস্তার করছে।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ২০১৪ সালে পপুলার শব্দ ছিল ‘ভেপ’ বা ধোঁয়া। তার মানে তারা কি পরিমাণ প্রচারণা চালিয়েছে, এতে সেটাই বোঝা যাচ্ছে। শুধু তরুণ নয়, শিশুদের মধ্যেও ই-সিগারেটের বিস্তার ঘটছে। ই-সিগারেটের পরিবেশত ক্ষতি ও বায়ুদূষণ নিয়ে আলাদা গবেষণার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।

দ্য ইউনিয়নের কারিগরি পরামর্শক ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, বাংলাদেশে নতুন এ তামাকপণ্যের বিস্তারে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো আগ্রাসী বিপণন কৌশলের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের আগ্রাসী কার্যক্রম এভাবে অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। তাই অবিলম্বে ই-সিগারেটের নিষেধাজ্ঞা আরোপই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।

গবষেণার সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৮০ শতাংশ বিক্রেতা জানিয়েছেন, ই-সিগারেট ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক সাইট উভয়ই ব্যবহার করেন। ৯৪ শতাংশ দোকান সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। তারা অফলাইন মিডিয়াও ব্যবহার করে। তরুণদের ই-সিগারেট ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি ভ্যাপিং উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। বহুজাতিক তামাক কোম্পানির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভ্যাপিং পণ্য বাংলাদেশে দেদার বিক্রি হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক জায়গায় শীর্ষস্থানীয় কোনো কোনো তামাক কোম্পানির সরাসরি তত্ত্বাবধানে ই-সিগারেটের দোকান পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকা নগরীতে অন্তত ৩৯টি আউটলেটের সন্ধান পাওয়া যায়, যেখান থেকে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি পর্দার অন্তরাল থেকে ই-সিগারেট বিক্রি করছে।

বিগত ২২ বছরের ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে অনেক বহুজাতিক তামাক কোম্পানি নিরবে অনেক ই-সিগারেট ব্র্যান্ড এবং ই-সিগারেটের সম্পৃক্ত অন্যান্য অনেক পণ্যের ট্রেডমার্ক নিবন্ধন নিয়ে রেখেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার মাধ্যমে ই-সিগারেট আমদানি করা যেমন এ তামাকপণ্য বাংলাদেশে বৈধকরণের কূটকৗশলের অংশ, তেমনি ট্রেডমার্ক নিবন্ধন বৈধকরণের আরেকটি কূটকৗশল।

ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মাওলার সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেনÑ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক বজলুর রহমান, বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী হেলাল আহমদ ও বিএনপিটিপির হামিদুল ইসলাম হিল্লোল।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০