নজরুল ইসলাম: ভুয়া ও জাল সনদপত্র দাখিলের মাধ্যমে চাকরি নিয়েছেন এক ব্যক্তি। প্রকৃত তথ্য গোপন করে ভুয়া তথ্য-সংবলিত সনদ তৈরি ও প্রদান করে অবৈধভাবে চাকরি গ্রহণে তাকে সহযোগিতা করেছেন প্রধান শিক্ষক। জাতীয় পরিচয়পত্রধারী ও এসএসসি পাস হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো যাচাই-বাছাই না করে তার জš§নিবন্ধন সনদ পেতে সহযোগিতা করেছেন এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান। ভুয়া ও জাল সনদে চাকরি নেয়া এই ব্যক্তির নাম মো. শামছুর রহমান। তিনি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) জুনিয়র তড়িৎবিদ হিসেবে নিয়োগ পান। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শামছুর রহমানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সহকারী পরিচালক জিএম আহসানুল কবীর বাদী হয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) মামলাটি দায়ের করেছেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন, শৈলাকুপার বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ৫নং কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন জোয়ার্দার মামুন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, মো. শামছুর রহমান ১৯৯০ সালে বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৯৯৫ সালে ওই বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে যশোর বোর্ড থেকে প্রথম শ্রেণিতে এসএসসি পাস করেন। তিনি ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) বিভিন্ন প্রকল্পে ‘কাজ নাই, বেতন নাই’ ভিত্তিতে গাড়িচালক পদে চাকরি করেন। ওই সময় এসএসসি পাসের সনদ, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দাখিল করেন, যেখানে জš§তারিখ ছিল ১৯৮০ সালের ২৪ জুন। কিন্তু পিজিসিবির রাজস্ব খাতের ‘টেকনিক্যাল অ্যাটেনডেন্ট’ পদে চাকরি নেয়ার সময় ৩০ বছরের বয়সসীমা ঠিক রাখতে ১৯৮২ সালের ২৪ জুন জš§তারিখ উল্লেখ করে অষ্টম শ্রেণি পাসের একটি ভুয়া সনদপত্র দাখিল করেছেন। ওই সনদেই ২০১৩ সালের ১২ মে পিজিসিবির জিএমডি, ঢাকা সেন্ট্রাল দপ্তরে টেকনিক্যাল অ্যাটেনডেন্ট পদে যোগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে চাকরিতে স্থায়ী হন। পরে দুদকের অনুসন্ধান ও পিজিসিবির বিভাগীয় তদন্তে ওই কাগজপত্র জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, অনুসন্ধানকালে ভুয়া ও জাল সনদপত্র দাখিলের মাধ্যমে শামছুর রহমানের চাকরি গ্রহণের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রকৃত তথ্য গোপন করে ভুয়া তথ্য-সংবলিত সনদ তৈরি ও প্রদান করে অবৈধভাবে চাকরি গ্রহণে সহযোগিতা করেছেন প্রধান শিক্ষক। শামছুর রহমান জাতীয় পরিচয়পত্রধারী ও এসএসসি পাস হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো যাচাই-বাছাই না করে তার জš§নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করেছেন চেয়ারম্যান।
চালক পদে যোগদানকালে শামসুর রহমান জীবন-বৃত্তান্তের সঙ্গে এসএসসি পাসের সনদ, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দাখিল করেন। সব কাগজপত্রে তার জš§তারিখ ছিল ২৪-০৬-১৯৮০। পিজিসিবির প্রকল্পে কর্মরত থাকাবস্থায় ২৮-১২-২০১১ পিজিসিবির রাজস্ব খাতের ‘টেকনিক্যাল অ্যাটেনডেন্ট’ পদে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তির আলোকে ২৬-০১-২০১২ ওই পদে নিয়োগ লাভের জন্য তিনি আবেদন করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল অষ্টম শ্রেণি পাস এবং সাধারণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ০১-০১-২০১২ তারিখে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩০ বছর। ওই তারিখে শামছুর রহমানের বয়স ৩০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ায় তিনি সাহাপুর আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পাসের একটি সনদপত্র দাখিলের মাধ্যমে পিজিসিবিতে চাকরির জন্য আবেদন করেন। সনদপত্রে তার জš§তারিখ ছিল ২৪-০৬-১৯৮২। পরে পিজিসিবির নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ২২-০৪-২০১৩ তার নামে নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়। নিয়োগপত্রের নির্দেশনা মোতাবেক তিনি ১২-০৫-২০১৩ পিজিসিবির জিএমডি, ঢাকা সেন্ট্রাল দপ্তরে টেকনিক্যাল অ্যাটেনডেন্ট পদে যোগ দেন। শামছুর রহমান তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওয়াহিদুজ্জামানের কাছ থেকে ২৭-০৬-২০১১ তারিখের স্বাক্ষরে ১৯৯৪ সালে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার একটি ভুয়া সনদ সংগ্রহ করেন। তিনি ১৫-০৯-২০১৩ পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরম পূরণ করে তার কর্তৃপক্ষ বরাবর দাখিল করেন। পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমে তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস উল্লেখ করলেও বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করেন বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ওই বিদ্যালয় থেকে সংগৃহীত সনদপত্র পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দাখিল করেন। অর্থাৎ তিনি চাকরির মূল আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত সাহাপুর শহীদ আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটির তথ্য পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমে গোপন করে পরিকল্পিতভাবে বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সংগৃহীত নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ সংযুক্ত করেন। তার মূল আবেদনপত্র পিজিসিবির প্রধান কার্যালয়ে সংরক্ষিত থাকায় এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়াটি তার কর্মস্থল জিএমডি, ঢাকা সেন্ট্রাল থেকে সংঘটিত হওয়ায় তিনি উল্লিখিত প্রতারণার আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পান মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর তার চাকরির চুক্তি স্থায়ীকরণ করা হয়। পরে ০৮-০৩-২০২১ তারিখে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে পিজিসিবির বিভাগীয় তদন্ত কমিটির তদন্তকালে তার চাকরি আবেদনের সঙ্গে দাখিল করা সাহাপুর আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ওয়াহিদুজ্জামানের ২৭-০৬-২০১১ তারিখে স্বাক্ষরিত শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটিও সঠিক নয়। শামছুর রহমান প্রধান শিক্ষকের সহায়তায় অসৎ উদ্দেশ্যে ওই সনদটি তৈরি ও গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে, অভিযোগসংশ্লিষ্ট শামছুর রহমান ১৯৯২ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও সনদটিতে ১৯৯৪ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তার প্রকৃত জš§তারিখ ২৪-০৬-১৯৮০ হলেও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ২৪-০৬-১৯৮২। অন্যদিকে পিজিসিবির বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে বিদ্যালয়ের প্যাডে ২২-০৮-২০২১ তারিখে লিখিত বিবৃতিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দাবি করেন, শামছুর রহমানের নামে ইস্যু করা সনদটি যথাযথ আছে। তিনি বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করেন, শামছুর রহমান ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।
বিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী তার জন্মতারিখ ২৪-০৬-১৯৮২। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওয়াহিদুজ্জামান কমিটিকে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য প্রদান করে বিবৃতি দেন। অনুসন্ধানকালে প্রধান শিক্ষক বিবৃতি দেন, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি শৈলকুপার ৫ নম্বর কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন জোয়ার্দার মামুন ও দলীয় লোকজনের চাপে সনদটি প্রদানে বাধ্য হন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সনদ গ্রহণকালে তার জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদর্শনের বিষয়ে যে তথ্য দেন, তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কাঁচেরকোল ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তায় জন্মনিবন্ধন করান ২৭-১৬-২০১২ তারিখে। অন্যদিকে তাকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের প্রত্যয়ন প্রদান করা হয় ২৭-০৬-২০১১ তারিখে। ওই জš§সনদ ব্যবহার করে পরবর্তী সময় অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জাতীয় পরিচয়পত্রে জš§তারিখ পরিবর্তন করেন মর্মে প্রতীয়মান হয়। অনুসন্ধানকালে অভিযোগসংশ্লিষ্ট শামছুর রহমান ১৯৯৫ সালে এসএসসি পাসের সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, এসএসসি পাস সনদে তার জš§তারিখ ভুল ছিল। জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে তিনি তার জš§তারিখ সংশোধন করেন।