খেলাপি ঋণ বাড়াচ্ছে শিল্প খাত

রোহান রাজিব: অর্থ সংকটের সময়ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াচ্ছে। কিন্তু সেই ঋণের বেশিরভাগ আদায় হচ্ছে না। ফলে তা খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। সামগ্রিক ব্যাংক ঋণের তুলনায় শিল্প ঋণে খেলাপি বেড়েছে তুলনামূলক বেশি হারে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকায়। একই সময় শিল্প ঋণে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ২৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত এক বছরে পুরো ব্যাংক ব্যবস্থায় যে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে; এর মধ্যে ৬৭ দশমিক ৫০ শতাংশ শিল্প ঋণ। বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা বড় ঋণ শিল্প খাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ রকম হয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প খাতে মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৩০ হাজার ৮২৫ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৬০ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা; যা এ খাতে বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। পুরো ব্যাংক খাতের ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে যেখানে খেলাপি রয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৫০ দশমিক ৫২ শতাংশ রয়েছে শিল্প খাতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প খাতে ঋণ বিতরণে যথাযথ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঘুরেফিরে ঋণ পাচ্ছেন বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন না। আবার কেউ কেউ নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে বিদেশে পাচার করছেন। সাধারণত এসব টাকা আর ফেরত আসে না। ফলে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকার, যা গত ২০২১ সালের একই সময় ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্পঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

ব্যাংকাররা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তেল, গ্যাসসহ সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এছাড়া টাকার বিপরীতে ডলারের দাম গত বছরের তুলনায় অন্তত ২৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে শিল্প ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।

এ বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কভিডের পর থেকে আমাদের সহজ মনিটরি পলিসি ছিল; এছাড়া ঋণের সুদ কম থাকায় শিল্প খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।

তিনি আরও বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরজুড়ে আমদানির পরিমাণ কমছে। তবে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত আমদানি বিল পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে ঋণও বেড়েছে।

এদিকে শিল্পঋণ বিতরণ বাড়ার সঙ্গে আদায়ও বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আদায় বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ আদায় দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকায়, যা এক বছর আগে ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ আদায় বেড়েছে ৫৫ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিতরণ করা শিল্পঋণের মধ্যে ৭ লাখ ৩০ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এ অঙ্ক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে বকেয়া ছিল ৬ লাখ ৯১ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণের অঙ্ক ৯৩ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা, যা এর আগের বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৯৫ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা।

বিতরণ করা শিল্প ঋণের মধ্যে এক লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে বড় শিল্পে। মাঝারি শিল্পে বিতরণ হয়েছে ১১ হাজার ৭৪৯ কোটি এবং ক্ষুদ্র শিল্পে ১৮ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদি ঋণ বিতরণ হয়েছে ২৯ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকার। আর চলতি মূলধন বিতরণ হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৯৫ কোটি টাকা।

শিল্প খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, শিল্প খাতে ছোট প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড়দের খেলাপি ঋণের হার বেশি। কারণ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হওয়ার পরও পুনরায় ঋণ পাচ্ছে। তাই এ খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। এছাড়া পুনঃতফসিলকরণ ও পুনঃগঠন সুবিধার কারণে এ খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণখেলাপি ঋণের চেয়ে অনেক বেশি।

তিনি আরও বলেন, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি রয়েছে। এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদের নতুন করে ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিতে হবে। নতুন ঋণ যাতে না বাড়ে এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে এ খাতে খেলাপি ঋণ কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি হলে নতুন করে ঋণ পাওয়ার কথা নয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি পুনঃতপশিলের ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে ছেড়ে দিয়ে একটা উদার নীতি দেখিয়েছে। এতে খেলাপি কমার চেয়ে আরও বাড়বে। এছাড়া আইনি প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় আদায়ের ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখায় না। তাই এ প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। আর আইনি প্রক্রিয়া সহজ হলেই খেলাপি ঋণ আদায় বাড়বে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০