নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। গতকাল ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে এ আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করেছে। তবে এরপরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি কাজ করেছেন র্যাব, পুলিশ, বিমান, নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া ব্যবসায়ীরাও আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সাহায্য করেন। মার্কেটে আগুনের ঘটনায় মোট ১২ প্লাটুন বিজিবি এবং র্যাবের ১৭টি টিম কাজ করেছে। পরে মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে ঢাকা কলেজের পুকুর থেকে পানি নেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সকাল থেকে কলেজের পুকুরে ১০টির বেশি পাম্প বসানো হয়। এতে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এদিকে এ ঘটনায় আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে নিউ সুপার মার্কেটের মালিক সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, সিটি করপোরেশনের লোক রাত ৩টার দিকে ব্রিজ ভাঙার কাজ করছিল। ব্রিজের ওখানে আমাদের কারেন্টের লাইন রয়েছে, সেটা তারা খেয়াল করেনি। ওই লাইনের ওপর বুলডোজার চালানোর সময়ই আগুনের সূত্রপাত হয়। তারা কোনো পরিকল্পনা না করে এ ব্রিজ ভাঙার কারণে আজ এ দশা হয়েছে।
এছাড়া দুপুরে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, আগুন লাগা নিউ সুপার মার্কেটের তিনতলা ভবনে এক হাজার দুইশ’র মতো দোকান রয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত ধারণা করছি, প্রায় ২৫০টির মতো দোকান পুড়ে গেছে। কারণ একপাশ আগুনে একেবারে পুড়ে গেছে। এছাড়া অনেক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর ভেতরে ঢুকলে আসল চিত্র জানা যাবে।
তিনি জানান, বঙ্গবাজারের ক্ষত কাটতে না কাটতে নিউমার্কেটে আগুন লাগল। আমরা এ আগুনের দ্রুত তদন্ত চাচ্ছি। কোনো নাশকতা না অন্য কিছু, তা তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসুক। এরপর সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমাদের চাওয়া।
এতে শতকোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। আর সবচেয়ে বেশি ফুটপাতের শতাধিক দোকানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তারা।
এদিকে বিভিন্ন মার্কেটে আগুনের ঘটনা ষড়যন্ত্র বা নাশকতা কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার ও জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন। সভায় সভাপতিত্ব করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, দেশব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটগুলোয় নজরদারি বাড়াতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের বিষয়টি জড়িত কি না, তাও তদন্ত করে দেখতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তারা অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটিয়ে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সবাইকে আরও সচেতন থাকতে হবে। সবার নিজস্ব উদ্যোগে পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে সব প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর সময় অযথা ভিড় করা যাবে না। কোনো প্রকার বাধা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেছেন, ঈদের আগে কেন মার্কেটে মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেন বিষয়টি খতিয়ে দেখে।
গতকাল সকাল সোয়া ১০টায় ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেটের সামনে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন। ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন রাখেন, ঈদের ঠিক আগে একের পর এক মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ আগুন ভোরে ঘটছে। ব্যবসায়ীরা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ আগুনের ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা কি না? নাশকতা কি না?
জবাবে ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করব এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্যÑকেন একের পর এক মার্কেটগুলোয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
মার্কেটের তৃতীয় তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। ভবনটিকে ২০১৬ সালে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এদিকে অগ্নিকাণ্ডে আহত ৩৫ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তারা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ১৩ জন ফায়ার সার্ভিসের সদস্য। আর ১৬ জন দোকানমালিক ও কর্মচারী।
আহত অন্যদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবী কর্মী তিনজন, বিমানবাহিনীর সদস্য একজন, আনসার সদস্য একজন ও একজন সাংবাদিক রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই আগুনের ধোঁয়ায় আহত হয়েছেন। এছাড়া মার্কেটে টিন লেগে কয়েকজন জখম হয়েছেন।
আহত ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা হলেনÑরাসেল (২২), শান্ত (২৪), তৌফিক (২৩), রাজন (২৫), মিলন (২৬), সজীব (২৫), আরিফুল (২৬), কামরুজ্জামান (২৫), শরিফুল (২৪), রাজিব (২২), ডিপজল (২৪), আলমগীর (৩৬) ও সোহেল রানা (৩৫)।
ঢামেকে চিকিৎসাধীন দোকান মালিক ও কর্মীরা হলেনÑরিফাত (২৩), বায়জিদ (২৫), হাসান (২০), রিমন (২৮), কামাল হোসেন (৩৩), ফিরোজ আলম (৩০), জীবন (৩০), জিসান (১৮), ইয়াসিন (২৪), জীবন (২৫), স্বপন (২৩), ফারহান (২৪), সারফিন (১৮), ইমাম হোসেন আলী (২৬), রাশেদ (৩০) ও সাব্বির (১৮)।
আহত অন্যরা হলেনÑএটিএন নিউজের সাংবাদিক মনিরুজ্জামান (৩৩), বিমানবাহিনীর সদস্য সার্জেন্ট আরাফাত (৩২), আনসার সদস্য সবুজ (২০), স্বেচ্ছাসেবী সাব্বির (৩০), জাকির হোসেন (২৭) ও চান মিয়া (১৮)।
পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এর উল্টোপাশে চাঁদনি চক মার্কেটে এরই মধ্যে দোকান খুলে বেচাকেনা শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, আগুন লাগা নিউ সুপার মার্কেটের সঙ্গে চাঁদনি চক মার্কেটকে সংযুক্ত করেছে একটি ওভারব্রিজ। ওভারব্রিজের একপাশে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট, অন্যপাশে চাঁদনি চক মার্কেট। নিউ সুপার মার্কেটে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেলেও চাঁদনি চক মার্কেটে অনেক তরুণী ও নারীদের কেনাকাটা করতে দেখা গেছে। তবে আগুন লাগা মার্কেট থেকে বেলা ২টা ২০ মিনিটের দিকেও ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে।
এদিকে নিউ সুপার মার্কেটে লাগা আগুন নাশকতামূলক ঘটনা কি না, তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে র্যাবের তদন্ত দল। গতকাল বিকালে বিষয়টি জানিয়েছে র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইং।
র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক এএসপি আ ন ম ইমরান খান জানান, নিউমার্কেট এলাকার অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর র্যবের টহল দল ও সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যদের দল ঘটনাস্থলে যায়। তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে। র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করেন এবং মাইকিংয়ের মাধ্যমে উৎসুক জনতাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সার্বক্ষণিক কাজ করেন।
তিনি আরও জানান, আগুনের ঘটনার পেছনে কোনো ধরনের নাশকতা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে র্যাবের গোয়েন্দারা কাজ করছেন।
এএসপি আ ন ম ইমরান খান জানান, নিউ সুপার মার্কেটের বিভিন্ন দোকান থেকে মালামাল বের করে দোকান মালিকদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করতে সহযোগিতা করেন র্যাবের সদস্যরা। এছাড়া আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার সদস্য ও ভলান্টিয়ারদের খাবার পানি সরবরাহ করেন র্যাব সদস্যরা।
অপরদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, আপনারা জানেন আমাদের মার্কেটগুলো যেভাবে তৈরি করা, তার বেশিরভাগ ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস অনেক মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। আমাদের পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করব। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত নিউমার্কেট এলাকায় পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আপনারা জানেন, আগে দুটা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এরপর আমাদের বঙ্গবাজারে একটি বড় আগুনের ঘটনা ঘটল। গতকাল রাতে হাজারীবাগের একটি ট্যানারিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আজকে ভোরে আবার এ নিউমার্কেটে আগুন লেগেছে। বিস্ফোরণের দুটা ঘটনাতেই আমরা মামলা নিয়েছি। বঙ্গবাজারে আপনার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আর আমরা ইন্টারনাল একটা তদন্ত করেছি। যদিও তদন্ত কমিটি করা হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিস্ফোরণের দুটি ঘটনা (সায়েন্সল্যাব ও গুলিস্তান) প্রাকৃতিক গ্যাস জমার কারণে অ্যাক্সিডেন্ট। কারণ আমাদের তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো নাশকতার আলামত খুঁজে পাইনি। আর দুটি আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন দেখলে বুঝতে পারব এগুলো নাশকতা না দুর্ঘটনা।