নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার আগে বেশ কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর শর্তগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে সফরে আসে সংস্থাটির প্রতিনিধিদল। সংস্থাটির ঢাকা সফরকারী স্টাফ কনসালটেশন মিশন গত মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করার পর ফের গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ পুরো খাতে সমস্যা তৈরি করছে বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়ায় সন্তুষ্ট সংস্থাটি। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, গতকাল ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ও ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুর রহমান খান ও আবু ফরাহ মো. নাছের। বৈঠকে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি, প্রভিশন, বাণিজ্যিক ব্যাংক, সহযোগী প্রতিষ্ঠান, ইক্যুইটি বাজার, সাম্প্রতিক ক্রিয়াকলাপ এবং ঝুঁকিবিষয়ক আপডেট, ১০টি ব্যাংকের সঙ্গে পাইলট প্রকল্প, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি উন্নতি ও ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য সংস্কারের অগ্রগতি জানতে চায় আইএমএফ। এ ছাড়া বৈঠকে ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের তারল্য সংকটের বর্তমান অবস্থা এবং এ সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য ও ডলার সহায়তা দেয়ার বিষয় জানতে চায় আইএমএফ।
বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটা ব্যাখ্যা দেয়া হয়। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা। এ ঋণের ৮০ শতাংশের এনপিএল হচ্ছে পাঁচ শতাংশের নিচে। বাকি ২০ শতাংশ ঋণের এনপিএল অনেক উচ্চই। এই ২০ শতাংশের বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৮০ শতাংশ ঋণ থেকে নিয়মিত আয় হচ্ছে ব্যাংকগুলোর। উচ্চ খেলাপির কারণে বাকি ২০ শতাংশ ঋণ থেকে তেমন আয় হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন ব্যাখ্যার পর এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি আইএমএফ প্রতিনিধিদল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চাপ রয়েছে। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা আইএমএফকে জানানো হয়েছে। সেই উচ্চ খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটা ব্যাখ্যাও তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকায়, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দ মানের ঋণই রয়েছে ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা, বা ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন রাখতেও ব্যর্থ হয় এ খাতের কিছু ব্যাংক। তাই প্রভিশনের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চায় সংস্থাটি। অন্যদিকে গত ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটি মূলধন ঘাটতিতে ছিল।
সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন মন্ত্রিসভায় পাস হওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কেও সংস্থাটিকে অবহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন, ২০২১’ পাশ হয়েছে। আগামী দেড় মাসের মধ্যে তা সংসদে উত্থাপন করা হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফকে জানানো হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন মন্ত্রিসভায় পাশ হওয়া এবং চলতি বছরই তা সংসদে উত্থাপনের সম্ভাবনা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দাতা সংস্থাটি। কারণ বাংলাদেশকে দেয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের যেসব শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি, তার মধ্যে ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে ‘সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন, ২০২১’ উত্থাপনের বিষয়টিও রয়েছে।