টার্মিনাল পরিচালনা-ব্যবস্থাপনায় একাধিক বিদেশি অপারেটর

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক টার্মিনাল পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার কাজ পেতে আগ্রহী একাধিক বিদেশি অপারেটর। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং চট্টগ্রাম বন্দরের গতি বাড়ানোর অংশ হিসেবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বন্দরে বিদেশি সরকারি অপারেটর নিয়োগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) এবং বে টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বিদেশি অপারেটরদের সংযুক্ত করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে সৌদি আরব, দুবাই, জাপান, সিঙ্গাপুরের সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েক কর্মকর্তার সূত্রে জানা যায়, কনটেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক মান, দক্ষতা ও গতি আনার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগের আশায় সরকার বন্দরের তিনটি টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে এনসিটি পরিচালনার জন্য দুবাইভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ২০০৭ সালে প্রায় ৭০০ কোটি ব্যয়ে নির্মিত এনসিটিতে মোট ১৮টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের মধ্যে এই টার্মিনালে রয়েছে ১৪টি। এই টার্মিনাল বন্দরের বেশিরভাগ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে। বর্তমানে দেশীয় বেসরকারি টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক পরিচালনায় আছে। আর বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকার ব্যয়ে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণকাজ সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে। এ টার্মিনালে বছরে সাড়ে ৪ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রার সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এটি নির্মাণ করে। টার্মিনালটি চালু করার উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত চালু হয়নি। এই টার্মিনালে কোনো ইকুইপমেন্ট স্থাপন করা হয়নি। বিদেশি অপারেটর নিয়োগ হলে টার্মিনালে প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট স্থাপন করা হবে। মূলত বিল্ড অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) ভিত্তিতে পতেঙ্গা টার্মিনাল অপারেশনের জন্য সৌদি আরবের রাজপরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) কাজ পেতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই কোম্পানির সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষি। এই টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের ব্যাপারে উপদেষ্টা হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অপরদিকে হালিশহরে বে টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালের মধ্যে একটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে সরকার। আরেক টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি পিএসএ। তবে এই টার্মিনালের একটি অংশ পরিচালনার দায়িত্ব পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মাতারবাড়ি বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব জাপানের একটি অপারেটরের হাতে যাচ্ছে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে ডলারের যে সংকট তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বিদেশি অপারেটরদের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।

সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ করা হলে বন্দরের ৯ শতাংশ খরচ কমবে এবং ৭ শতাংশ গতি বাড়বে। দক্ষিণ এশিয়ায় চট্টগ্রামই একমাত্র বন্দর, যেটি টুল পোর্ট অর্থাৎ বন্দর পরিচালনার সব দায়িত্ব সরকারের। অন্যদিকে বিশ্বের সব উন্নত বন্দর ল্যান্ডলর্ড অর্থাৎ যেখানে বেশিরভাগ কাজ পরিচালিত হয় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়, সরকার শুধু নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ল্যান্ডলর্ড মডেলে পরিচালিত হলে দেশের অর্থনীতি, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল হবে।

বন্দরে বিদেশি টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের বিষয়ে চবক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জাহাজ বহির্নোঙরে আসার এক থেকে দুই দিনের মধ্যে জেটিতে ভিড়ছে, ক্ষেত্রবিশেষে অন অ্যারাইবল বার্থিং দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৮৪ মিটার লম্বা জেটিসহ পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে বছরে সাড়ে ৪ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রার এ টার্মিনালে ২০০ মিটার লম্বা ১০ মিটার ড্রাফটের ২টি কনটেইনার জাহাজ এবং ২২০ মিটার লম্বা ডলফিন জেটিতে তেলবাহী জাহাজ ভিড়ানো যাবে। টার্মিনালটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি অপারেটর দ্বারা পরিচালনার সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পিপিপি কর্তৃক ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজর হিসেবে আইএফসিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা ট্রানজেকশন স্ট্রাকচার রিপোর্ট দিলে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। অপরদিকে বে টার্মিনালে তিনটি টার্মিনালের পিপিপি’র আওতায় দুইটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে। বাকি একটি চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা করবে। এতে আমাদের দক্ষতা বাড়বে। বন্দরের আয়ও বাড়বে। আর মাতারবাড়ি বন্দরে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ২৩০ মিটার লম্বা ও ১৩ মিটার ড্রাফটের ৮০ হাজার ডিডব্লিউটির কয়লাবাহী জাহাজ ভিড়ানো হয়েছে। এ বন্দরে ১৬ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। বড় জাহাজে বেশি কার্গো এলে ভাড়া কমবে, আয় বাড়বে। ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সশিপমেন্ট হবে মাতারবাড়ী। আমাদের তিনটি সমুদ্রবন্দর ছাড়াও প্রতিবেশী দেশগুলো এ বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। তাই আমাদের আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরে রূপান্তর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগকে অটোমেশন করতে ৫০টি সফটওয়্যার মডিউল তৈরি হচ্ছে। যার মাধ্যমে বন্দরকে পেপারলেস প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব হবে। বিপজ্জনক, তেজস্ক্রিয়, রাসায়নিক পণ্য নিরাপদে আমদানি রপ্তানির সুবিধার্থে স্টেট-অব-আর্ট কেমিক্যাল শেড গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে এক দশকে ৫ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মাণ করায় কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৫৫ হাজার টিইইউসে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে শিপ টু শোর কি গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের ৩১০টি ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। ফলে ইজি অব ডুয়িং বিজনেসের সব সূচক আমরা দ্রুত অর্জন করেছি। বর্তমানে ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর সক্ষম। ইতোমধ্যে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্টের কয়েকটি ট্রায়াল রান সফল হয়েছে।

উল্লেখ, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০ ফুট দীর্ঘ ৩১ লাখ ৪২ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। একই সময়ে জেনারেল কার্গো ওঠানামা হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লাখ টন। আর জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪ হাজার ৩৬১টি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০