সাধারণ মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য যে পরিবহনের সাহায্য নেয়, সেটিই গণপরিবহন। একসময় মানুষ দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গন্তব্যস্থলে পৌঁছাত। এ সময় কখনও মাস বা বছরেও পরিণত হতো। কিন্তু সভ্যতার ছোঁয়ায় সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে উন্নত হয়েছে মানুষের যোগাযোগ। বিভিন্ন ধরনের যানবাহন বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরচালিত ভ্যান প্রভৃতি নামের যানবাহন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এতে করে মূল্যবান কর্মঘণ্টা যেমন নষ্ট হয় না, তেমনি দ্রুত গন্তব্যেও পৌঁছানো যায়। কিন্তু সমস্যার বিষয় হচ্ছে, দ্রুত ও সময় নষ্ট না করার চক্করে অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হচ্ছে মানুষের মহা মূল্যবান জীবন। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়তই ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবর শিরোনাম হতে দেখা যায়, যা যানবাহন আবিষ্কারের আগে দেখা যেত না। কেননা তখনকার দিনে এমন দুর্ঘটনা ঘটার সুযোগ ছিল না। তাহলে কি যানবাহনের আবিষ্কারই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে? যানবাহন ব্যবহার করাই ভুল হয়েছে? তা অবশ্যই নয়।
কোথাও যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হলে কিছু সময় অপেক্ষার পর দেখা মেলে ফিটনেসহীন ও যাত্রীতে ঠাসা বহুল কাক্সিক্ষত গাড়ির। সেখানে সিট না পেলেও দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া গেছেÑএটা ভেবেই নিজেকে ভাগ্যবান মানতে হয়। এ পরিস্থিতিতে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এভাবে কিছু সময় যাওয়ার পর যানজটে পড়তে হবে, এটা একটা চিরাচরিত সত্য ঘটনা। গাড়িভাড়া নেয়ার বিষয়টাও কম অদ্ভুত নয়, যার কাছে যত বেশি ভাড়া পাওয়া যায় নেয়া হয়। অনেক যাত্রী বাকবিতণ্ডায়ও জড়িয়ে যান। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য ই-টিকেটের সিস্টেম চালু করা হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ যাত্রীর মাঝ রাস্তায় ওঠা-নামার জন্য ই-টিকেট কোনো কাজে আসে না। যানজট কিছুটা শিথিল হওয়ার পর গাড়ির চালকরা ভুলে যায় যে, রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ি আছে বা কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক, কেননা অধিকাংশ গাড়ির চালক ও হেল্পারের কোনো লাইসেন্স ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। কোন গাড়ি কত আগে যেতে পারে, সেসব রেস চলতে থাকে চালকদের। ফলে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার শিকার হয় সাধারণ যাত্রীরা। এসব ভোগান্তি যাত্রীরা মুখ বুজেই মেনে নিয়েছে।
সম্প্রতি মাদারীপুরের এক্সপ্রেসওয়েতে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা ঘটেছে, তার দায় কে নেবে? এ দুর্ঘটনায় ১৯ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। অনেকে পঙ্গু হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল যারা দেশের হয়ে অবদান রাখতে পারত এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সেই পরিবারগুলোর দায়িত্ব নেবে কে? সরকারের ডিজিটাল দেশ গড়ার অঙ্গীকার আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দেশের ট্রাফিক সিস্টেম আজও পুরোনো আমলেই পড়ে আছে। বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট সবার টনক নড়ে, কিন্তু কালক্রমে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে, যা নতুন একটি দুর্ঘটনার কারণ হয়।
উল্টোপথে চলাচল ও ওভারব্রিজের ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার মতো ঘটনা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আইন ভঙ্গ করাটাকে আমরা আনন্দের বিষয় হিসেবে পরিণত করে ফেলেছি। সবকিছুর পাশাপাশি আমাদের নিজেদের সবচেয়ে বেশি সচেতন ও আইন মেনে চলা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের এই সেক্টরের প্রতি গভীর নজরদারির মাধ্যমে এই সেক্টরে কিছুটা অনিয়ম কমানো সম্ভব, নয়তো প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ও গণপরিবহনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। মালিক, শ্রমিক ও যাত্রী সবারই সমঝোতার মাধ্যমে এই খাতকে একটি সেবামূলক খাতে পরিণত করতে হবে।
অমিত কুমার দেবনাথ
শিক্ষার্থী, সংস্কৃত বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়