শীর্ষ ঋণখেলাপিদের থেকে অর্থ আদায়ে ব্যর্থ অগ্রণী ব্যাংক

রোহান রাজিব: রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অগ্রণী ব্যাংক শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারছে না। এসব ঋণখেলাপির কাছে এক রকম জিম্মি হয়ে আছে এ ব্যাংক। ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ আটকে রয়েছে শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে। প্রতিবছর এসব ঋণখেলাপির কাছ থেকে অর্থ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বেঁধে দেয়া এসব লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণখেলাপির কাছ থেকে অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংক। ফলে আদায় অবস্থা দাঁড়িয়েছে নাজুক পরিস্থিতিতে। গত বছর শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩২ শতাংশ আদায় করতে পেরেছে ব্যাংকটি। এছাড়া অন্য ঋণখেলাপি ও অবলোপন ঋণ থেকে আদায় অবস্থা আরও নাজুক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর স্বাক্ষরিত ডিসেম্বরভিত্তিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবছর লক্ষ্যমাত্রা দেয়। তবে এটা শুধু দেয়ার জন্যই। কারণ শীর্ষ ঋণখেলাপি যারা, তাদের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতও রাখা হয়নি। তাই মামলা করার পরও এসব ঋণখেলাপি থেকে অর্থ আদায় হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংক গত বছর শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র ৯৭ কোটি টাকা বা ৩২ দশমিক ৩৩ শতাংশ ঋণ আদায় করতে পেরেছে। ২০২১ সালে ব্যাংকটি ২৪০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৩৯ কোটি টাকা বা মাত্র ১৬ শতাংশ আদায় করতে সক্ষম হয়। গত বছর ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ৭০০ কোটি টাকার বিপরীতে ব্যাংকটি আদায় করেছে ২৬০ কোটি টাকা বা ৩৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২০২১ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে ঋণের স্থিতি ছিল দুই হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা আর অন্য খেলাপির কাছে ছিল সাত হাজার ৪২ কোটি টাকা।

এছাড়া অবলোপন ঋণ থেকে ব্যাংকটি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে রাইট-অফ বা অবলোপন ঋণ থেকে ব্যাংকটির আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০৫ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটি লক্ষ্যমাত্রার ২১ দশমিক ৭৩ শতাংশ বা ৮৮ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। ২০২১ সালে আদায় করতে পেরেছে লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির অবলোপন ঋণের স্থিতি ছিল চার হাজার ৪৫ কোটি টাকা।

শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে কেন অর্থ আদায় করতে পারছে না অগ্রণী ব্যাংকÑএ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুরশেদুল কবীর শেয়ার বিজকে বলেন, শীর্ষ ঋণখেলাপির কাছ থেকে কীভাবে অর্থ আদায় করা যায়, সে বিষয়ে ব্যাংকের বোর্ড আলাদাভাবে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মামলার পরও অন্য কোন পন্থায় অর্থ আদায় করা যায়, সে পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অন্যান্য ব্যাংক থেকে এখন অগ্রণী ব্যাংক আমানত, ঋণ ব্যবস্থাপনা, রেমিট্যান্স ও এজেন্ট ব্যাংকিংসহ অন্যান্য দিকে ভালো করছে। তবে আমাদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। মূলত কভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছিল। পরিস্থিতি ভালো হওয়ার পর সে সুযোগ তুলে নেয়া হয়। তবে অনেক গ্রাহকের ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারণে ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। আমরা এখন তাদের সঙ্গে বসে আলাপ করছি ঋণগুলো যাতে পুনঃতফসিল করে। আশা করছি, আগামী জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কমে আসবে।

সূত্রমতে, অগ্রণী ব্যাংক ৫১ ঋণগ্রহীতার কাছে জিম্মি। কারণ ঋণের সিংহভাগ ৫১ গ্রাহকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অগ্রণী ব্যাংকে গত ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৭১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে ২৯ হাজার ৯৮২ কোটি টাকাই বিতরণ করা হয়েছে মাত্র পাঁচ শাখার মাধ্যমে। সে হিসেবে অগ্রণী ব্যাংকের ৪২ শতাংশ ঋণই মাত্র পাঁচ শাখায় কেন্দ্রীভূত। এ পাঁচ শাখার ঋণ নিয়েছেন ৫১ গ্রাহক। তাদের মধ্যে সাতজন সরকারি খাতের এবং ৪৪ জন বেসরকারি খাতের ঋণগ্রহীতা। তাদের কাছে যাওয়া ঋণের মধ্যে রয়েছে ২৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার ফান্ডেড লোন এবং পাঁচ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড লোন।

অগ্রণী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া তাদের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের মূলধনের ঘাটতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মূলধন ছিল সাত হাজার ৩১১ কোটি টাকার। যেখানে নিয়ন্ত্রক সহনশীলতাসহ এর নিয়ন্ত্রক মূলধন গত বছরের শেষে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৭২ কোটি টাকায়, কিন্তু এর প্রকৃত নিয়ন্ত্রক মূলধন ছিল ঋণাত্মক এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার।

গত বছর ব্যাংকটি তারল্য সংকটেও ভুগেছে। এর মূল কারণ ছিল আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়া। ২০২১ সালের ব্যাংকটিতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ১৬ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। গত বছর তা কমে দুই হাজার ৪৭১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তারল্য সংকটে থাকার কারণে ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত ধার করছে।

২০২১ সালে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৭ শতাংশ, তা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলা হয়। তবে গত বছর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার বেড়ে হয়েছে ২২ শতাংশ। খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে পাঁচ হাজার তিন কোটি টাকা রয়েছে ৯ ঋণগ্রহীতার কাছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০