রাজস্ব কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ ভাই স্ত্রী সন্তানের নামে হেবা

নজরুল ইসলাম: গোয়েন্দা কর্মকর্তা পদে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত পরিদপ্তরে ৪২৫-১০৩৫ টাকা স্কেলে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। আর রাজস্ব কর্মকর্তা (সুপার) হিসেবে অবসরে যান। চাকরিকালে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। সেসব গোপন করতে ভাই, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে কিনে পরে তা আবার নিজ নামে হেবা করে নেন। যৌথ নামে বিভিন্ন ফিক্সড ডিপোজিট ও অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন। এসব টাকা তারই এবং তিনি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তা লুকানোর চেষ্টা করেছেন। তার নাম মো. আলাউদ্দিন। বাড়ি রংপুরে। অনুসন্ধানে তার ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়েছে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, কমিশন মামলার অনুমোদনও দিয়েছে। শিগগিরই মামলা দায়ের করা হবে।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলাউদ্দিন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে ৬১ অযুতাংশ জমিসহ ১৫০০ বর্গফুটের একটি  ফ্ল্যাট নিজ নামে ২০০৬ সালের ৩০ এপ্রিল ৭ লাখ ৫ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন। ২০০৭ সালের ১৩ নভেম্বর সেই ফ্ল্যাটটি স্ত্রী ও মেয়ের নামে হেবা ঘোষণা করেন। তখন মূল্য দেখানো হয় ১৩ লাখ টাকা। রংপুরের বিনোদপুর মৌজায় ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ২১ লাখ টাকায় ১০০ শতাংশ জমি কেনেন। পরে দেখিয়েছেন সেই জমি ভাই শহীদুল ইসলাম থেকে হেবা দলিলে পেয়েছেন। ২০১৯ সালের ৩ জুন রংপুরের আলমনগর মৌজায় ২০ লাখ টাকায় ৪.৫ শতাংশ জমি কেনেন। পরে এই জমির মধ্যে তার স্ত্রী পারভীন স্বামীর নামে ১.৫ ও ছেলের নামে ৩ শতাংশ জমি হেবা ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আলমনগর মৌজায় সাড়ে ৩ শতাংশ জমি ১ কোটি ২৬ লাখ টাকায় বায়না রেজিস্ট্রি করেন। ওই জমির ওপর তিনটি টিনশেডের দোকান নির্মাণ বাবদ ৬ লাখ টাকাসহ মোট ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয় করেন। দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ১ কোটি ২৬ লাখ টাকায় বায়না রেজিস্ট্রি করে যৌথমালিকানায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকায় দলিল করেন। ওই সম্পত্তি ঘুষ দিয়ে খারিজ করেছিলেন, যা পরে তদন্তসাপেক্ষে বাতিল করা হয়েছে। সেই হিসেবে তিনি ১ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকার সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রাধাবল্লভ মৌজায় ৩.১৬ শতাংশ জমি ১০ লাখ টাকায় কেনেন। পরে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেন।  আলমনগর মৌজায় ১০ শতাংশ জমি ৬৫ হাজার টাকায় কেনেন। ওই জমিতে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি তিনতলা বাড়ি

নির্মাণ করেন। ২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাধাবল্লভ মৌজায় ৩ লাখ টাকায় ০.০৭৯ শতাংশ জমি কেনেন। কিন্তু তিনি দেখান জমিটি তার ভাই শাহাজাদার কাছ থেকে হেবা হিসেবে পেয়েছেন। ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর দর্শনা পাহাড়ি মৌজায় ৩৫ লাখ টাকায় ১৬.৫ শতাংশ জমি তার স্ত্রীর নামে কেনেন। পরে দেখান জমিটি স্ত্রীর কাছ থেকে হেবা হিসেবে পেয়েছেন। ১৯৮৯ সালের ৮ জুন আলমনগর মৌজায় ৬ শতাংশ জমি ৩ লাখ টাকায় স্ত্রীর নামে কেনেন। ওই জমিতে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করেন। ২০০১ সালের ২৩ আগস্ট, ২০০৩ সালের ১১ জুন, ১৯৯৩ সালের ৯ মার্চ ও ১৯৯৫ সালের ১ অক্টোবর তারিখে চারটি দলিলে বিনোদপুর মৌজায় ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় ৯৯ শতাংশ জমি তার ভাই শাহাজাদার নামে কেনেন। ২০০৭ সালের ৩০ এপ্রিল দর্শনা পাহাড়ি মৌজায় ৯ শতাংশ জমি ভাই শাহাজাদা ও শহীদুল ইসলাম এবং স্ত্রী ও মেয়ে আলভিয়া তানজিনের নামে কেনেন। একই মৌজায় আরেকটি দলিলে ২৪ শতাংশ জমি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ভাই শাহাজাদা, শহীদুল ইসলাম, স্ত্রী পারভীন ও মেয়ে আলভিয়া তানজিনের নামে কেনেন। ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিনোদপুর মৌজায় ৩৭ শতাংশ জমি ১ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ভাই শাহাজাদার নামে কেনেন। আলাউদ্দিন মিয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলিলে কেনা মোট ৮১৫.৯৩ শতক জমির মূল্য ২ কোটি ৬৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকার তথ্য দিলেও দুদকের অনুসন্ধানে নির্মাণাধীন বাড়ি ও দোকানসহ ওইসব জমির মোট মূল্য ৫ কোটি ৯৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। এছাড়া মো. আলাউদ্দিন ও শাহাজাদার যৌথ নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ১ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার ৭২৫ টাকা পাওয়া গেছে। তার ভবিষ্যৎ তহবিলের ৪১ লাখ ৬৭ হাজার ৮০০ টাকাসহ ৭ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৭২৫ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৮৫ হাজার ৮৫৪ টাকার তথ্য আয়কর রিটার্নে দেখিয়েছেন। তার পারিবারিক ব্যয় ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৯৮৮ টাকা। পারিবারিক ব্যয় বাদে তার আয়ের পরিমাণ ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ টাকা। বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়সহ তার মোট আয় পাওয়া গেছে ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ টাকা। সেই হিসাবে তিনি ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে ভোগদখলে রেখেছেন। আলাউদ্দিন তার ভাই, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে জমি কিনে পরে তা আবার নিজ নামে হেবা করে নেন। যৌথ নামে বিভিন্ন ফিক্সড ডিপোজিট ও অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে আসছেন।

আলাউদ্দিন ১৯৮৭ সালের ১২ জানুয়ারি গোয়েন্দা কর্মকর্তা পদে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত পরিদপ্তরে ৪২৫-১০৩৫ টাকা স্কেলে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রংপুরে রাজস্ব কর্মকর্তা (সুপার) হিসেবে যোগ দিয়ে ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

৩ কোটি ৫১ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আলাউদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তাতে আপনার কী? আপনার কী সমস্যা?’ ‘আমার কোনো সমস্যা নেই’ জানিয়ে পুনরায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাহলে আমারও কোনো সমস্যা নাই। আপনি কথা বলতে চাইলে আমার বাসায় আসুন।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০