এক.
১৪মে অনুষ্ঠিত থাইল্যান্ডের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাসমর্থিত স্বৈরশাসক প্রধানমন্ত্রী প্রয়োথচান ওচার চরম ভরাডুবি হয়েছে। ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দল থাই নেশন পার্টি পাঁচশ আসনের জাতীয় সংসদে মাত্র পয়ত্রিশটি আসন লাভ করে সংসদে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে!
অন্যদিকে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, বিয়াল্লিশ বছরের এক তরুণ রাজনীতিবিদ পিটা লিমজারনবাথই হতে যাচ্ছেন থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। পিটার রাজনৈতিক দল মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি থাইল্যান্ডের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক রাজনৈতিক দল হিসাবে সর্বোচ্চ একশো আটচল্লিশটি আসনে জয়ী হয়েছে। মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি থাইল্যান্ডের সেনাশাসন এবং এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট পার্টি। পিটার নেতৃত্বাধীন উদার চিন্তা ভাবনার রাজনৈতিক দলটি শিক্ষিত তরুণ ভোটারদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ফিউচার ফরওয়ার্ড পার্টিকে থাইল্যান্ডে নিষিদ্ধ করা হলে ঐ পার্টির সমর্থকরাই মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি গঠন করে। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে যে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অগ্রগতি থামানো যায়না, পিটার নেতৃত্বাধীন মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির বিস্ময়কর জয়ই তারই প্রমাণ। দশ বছরের সেনাশাসনের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ডে সামরিক শাসন খুব কমন একটা ব্যাপার।অনেক গুলো নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে বার বার সামরিক স্বৈরাচারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র। এবার কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে থাইল্যান্ডে গনতন্ত্রের নতুন যুগ শুরু হবে যার নেতৃত্ব দিবে বিয়াল্লিশ বছরের এক তরুণ রাজনীতিবিদ পিটা লিমজারনবাথ। তিনিই হতে যাচ্ছেন থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
দুই.
এই নির্বাচনের আরেক আলোচিত রাজনৈতিক চরিত্র পেতুংতার্ন সিনাওয়াত্রা। ছয়ত্রিশ বছরের তরুণী। তাঁর নেতৃত্বাধীন পিউ থাই পার্টি পাঁচশ আসনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একশো সাইত্রিশটি আসন পেয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পিউ থাই পার্টিও মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির মতো সেনাসমর্থিত স্বৈরশাসন বিরোধী রাজনৈতিক দল। এই নির্বাচনে সেনাসমর্থিত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে পিটার নেতৃত্বাধীন মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি এবং পেতুংতার্ন সিনাওয়াত্রার নেতৃত্বাধীন পিউ থাই পার্টি জোটগত ভাবে নির্বাচন করেছে। পিউ থাই এবং মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির জোট সরকার গঠন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই নির্বাচনটি ছিল গনতন্ত্র ও স্বৈরশাসকের মধ্যে জনগণ কোনটি বেছে নিবে-এ সংক্রান্ত একটি অঘোষিত গণভোট। সাধারণ মানুষ জিতে গেল।
পেতুংতার্ন সিনাওয়াত্রার আরেকটি রাজনৈতিক ও পারিবারিক পরিচয় আছে। তিনি থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিলিওনিয়ার থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ে। থাইল্যান্ডের আরেক সাবেক নারী প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা পেতুংতার্ন সিনাওয়াত্রার ফুফু। সে হিসেবে পিতা ও ফুফুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসাবে পুরনো সমর্থকের সমর্থন পেয়েছেন। পেতুাংতার্নের পিতা থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে ২০০৬ সালে এবং ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে ২০১৪ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু সিনাওয়াত্রা পরিবারের থাইল্যান্ডের কৃষক শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে রয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা। সিনাওয়াত্রা পরিবারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাইল্যান্ডে সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসার নিশ্চয়তা, কৃষকের কৃষি ঋণ মওকুফ সহ আরও কিছু জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজ করে ছিল সে জন্য গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষেরা হচ্ছে পিউ থাই পার্টির ভিত্তি। অন্য দিকে তরুণ রাজনীতিবিদ পিটা লিমজারনবাথের রাজনৈতিক দল মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির রয়েছে শিক্ষিত তরুণদের মধ্য তুমুল জনপ্রিয়। সেজন্যই মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি এবং পিউ থাই পার্টির জোটের কাছে চরম ভরাডুবি হয়েছে সেনাসমর্থিত স্বৈরশাসক প্রধানমন্ত্রী প্রয়োথ চান ওচার। কর্তৃত্ববাদ এবং দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মানুষ মুক্তির জন্য গনতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে।থাইল্যান্ডের জনগণের এ এক দারুণ বিজয়। নতুন সূর্যোদয়।
তিন.
থাইল্যান্ডের পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। উচ্চ কক্ষ সিনেটের সদস্য সংখ্যা আড়াইশো এবং নিম্ন কক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের আসন সংখ্যা পাঁচশো। হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের পাঁচশ আসনের মধ্যে চারশো আসনে সরাসরি নির্বাচন হয় বাকী একশো আসন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ কারী রাজনৈতিক দল গুলোর ভোটের সংখ্যা অনুপাতে বন্টন করা হয়। উচ্চ কক্ষের আড়াইশো সিনেট সদস্যের সবাই সেনাবাহিনীর নিয়োগকৃত!তারা নির্বাচিত নয়। কিন্তু তারাও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ভোট দিতে চায়! রাজনৈতিক দল গুলোর দাবী জনগণের ভোটে নির্বাচিত এমপিরাই থাইল্যান্ডের নির্বাচিত করবে। সে হিসাবে সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির প্রধান হিসাবে তরুণ রাজনীতিবিদ পিটা লিমজারনবাথের এখন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
থাইল্যান্ডের এই নির্বাচনী ফলাফল কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের বিজয়।
মো:নিজাম উদ্দিন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক