সুকান্ত দাস: গরমের দিনে ঘরের চাতালে বসে দক্ষিণা বাতাসে কাঁচা আমমাখা খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। চারদিকে ধু-ধু করে ফাঁকা মাঠ। বছরে একবার আবার কোথাও বা দু’বার ধান চাষ হতো। বাকি সময়ে অন্যান্য সবজির চাষ হতো। গ্রীষ্মকালে শেষে যখন প্রথম বর্ষা হতো তখন মেঘের ডাকে পুরোনো পুকুর থেকে কই, শিং মাছ বের হওয়া যেন প্রাকৃতিক নিয়ম ছিল। নতুন পানির সঙ্গে বের হয়ে আসত শত শত প্রজাতির মাছ। কই, শিং, টাকি, শোল, গজার, পুঁটি, বাইন, ফাইশ্যা, রয়না, ফলই, চিতল, বোয়াল, খলিশা, ট্যাংরা ছিল এদের মধ্যে অন্যতম। বর্ষাকালে মাঠগুলো যখন জলে ডুবে থাকত তখন রাতের বেলা মাছ ধরা তো নিত্যকার ব্যাপার ছিল।
বর্ষাকালে দিনের বেলা কলাগাছের ভেলা বা তাল গাছের ডোঙ্গায় করে মাঠের পানির মধ্যে ঘুরে ঘুরে শাপলা তোলার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। কিন্তু এসব কিছু এখন শুধু স্মৃতি হয়ে আছে। সেই দিন আর নেই। আর সেই ফাঁকা মাঠও আর নেই। সময়ের সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই এলাকার এসব বিষয় কৃত্রিমভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে।
জমি কেটে ঘের তৈরি করা হয়েছে। ঘের হলো একটি আবদ্ধ ক্ষেত্র, যা জমিতে নালা কেটে বা গর্ত করে সেই নালা বা গর্তের মাটির চারপাশে উঁচু আইলের মতো বেঁধে জলাশয় তৈরি করা হয়।
চিংড়ি চাষে অধিক মুনাফার লোভে অধিকাংশ মানুষ তাদের দুই ফসলি, তিন ফসলি জমি কেটে ঘের তৈরি করেছে। যদিও এতে লাভ কম নয়। কারণ চিংড়িকে সাদা সোনা বলা হয়। কিন্তু চিংড়ি চাষের কারণে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চিংড়ি চাষ করতে নোনা পানি দরকার। আগে খালে বাঁধ দিয়ে নোনা পানি আসা বন্ধ করা হতো। কারণ নোনা পানি ফসলের চরম ক্ষতি করে। কিন্তু এখন চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি আনতে হচ্ছে। এতে ফসলের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। গলদা চিংড়ি মিষ্টি পানিতে চাষ করা গেলেও বাগদা চাষ করতে নোনা পানির দরকার হয়। নোনা পানির কারণে দেশের দক্ষিণবঙ্গের পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একসময়ের ফসলি জমি কেটে চিংড়ি চাষ করার কারণে ধান চাষ হুমকির মুখে পড়েছে।
নোনা পানির প্রভাবে গোটা দক্ষিণ উপকূল থেকেই ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে অন্তত ৬০ হাজার প্রজাতির মাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি। প্রথম দিকে কিছু কৃষক চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকলেও কয়েকবার চিংড়ি চাষ করে লোকসান হওয়ার পর তাদের সেই ইচ্ছে উঠে গেছে। এখন অধিকাংশ ঘেরে প্রভাবশালীরা চিংড়ি চাষ করে। এখানেই আসল সমস্যা। নোনা পানিতে কৃষকের ক্ষতি হলেও প্রভাবশালীদের ক্ষমতার দাপটে কৃষকদের কথা কেউ শোনে না। সাধারণ কৃষকরা এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই চিংড়ি চাষ করেন।
বাগেরহাট খুলনা সাতক্ষীরা এলাকায় ভবন তৈরি করার কিছুদিনের মধ্যেই ভবনের দেয়ালে ফাটলের সৃষ্টি হচ্ছে। দেয়ালের রং খসে পড়ে যাচ্ছে। এলাকার লোকজন এর জন্য নোনা পানিকে দায়ী করছে। অনেক পুরোনো গাছ মারা গেছে দক্ষিণ অঞ্চলে নোনা পানি ঢোকার পর। আগে চারদিক সবুজে ঢাকা ছিল। কিন্তু এখন আর তেমন নেই। নোনা পানির কারণে অনেক গাছপালা মরে গেছে।
নারকেল সুপারির ফলন খুব ভালো ছিল একসময় এ অঞ্চলে। কিন্তু লবণ পানি ঢুকার কারণে নারকেল-সুপারির ফলন অনেক কমে গেছে।
অনেকে বাধ্য হয়েছে চিংড়ি চাষ করতে। কারণ দেখা গেছে, আশপাশের সবাই চিংড়ি চাষ করে। ফলে সেই সব জায়গায় নোনা পানি থাকে। ঘেরের বাঁধের মধ্যে থেকে নোনা পানি ধানের জমিতে প্রবেশ করে। এ কারণে জমির ফসল উৎপাদন কম হয়। ফলে গরিব কৃষক বাধ্য হয়ে ধান চাষ বন্ধ করে।
দেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর সাগরের নোনা পানির প্রভাব এলাকার প্রকৃতির ওপর পড়ছে। এটা তো প্রাকৃতিকভাবে হচ্ছে। কিন্তু চিংড়ি ঘেরের কারণে মানবসৃষ্ট কৃত্রিমভাবে গ্রামগঞ্জের মাটি লবণাক্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের গবেষণায় জানা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের জেলা বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি আনতে সøুইস গেট ছিদ্র করে বাঁধ দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে। যার কারণে এসব এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতার।
এ এলাকার যেসব মানুষ আগে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাদের অধিকাংশই বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকে অন্য কাজ করছে। কিন্তু তারা আগে যেমন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিল, এখন তেমন নেই। অর্থনৈতিকভাবে অনেক অসচ্ছল হয়ে গেছে তারা।
কৃষি শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছেন, শিশু-কিশোররা খেলার মাঠ হারিয়েছে। পানির অবাধ প্রবাহ নষ্ট হয়ে গেছে ঘেরের কারণে। মনে হয় যেন এই ঘেরগুলো একপ্রকার ঘেরাও করে রেখেছে দেশ।
লবণাক্ততার কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া জমির উর্বরতা ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। এই সম্পর্কিত প্রতিটি গবেষণায় দেখা গেছে, নোনা পানিতে চিংড়ি চাষের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এসব অঞ্চলের চাষের জমি প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে।
৪০ শতাংশ কৃষিজমি মারাত্মক হুমকির মুখে। গবেষকরা বলছেন, ঘন ঘন নোনা পানির প্লাবনে ইতোমধ্যে অনেক কৃষক ধান চাষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কৃষকরা ধানের জমিতে চিংড়ি বা অন্য সামুদ্রিক মাছের চাষ করছেন এখন। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বর্গাচাষিদের আয় বছরে ২১ শতাংশ কমেছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় জানা গেছে, নোনা পানির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নারীদের গর্ভপাতের হার অন্য জায়গার তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। এটা খুবই চিন্তার একটা বিষয়।
এলাকায় নোনা পানি ঢোকার কারণে স্বাদু পানির খুব অভাব দেখা দিয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ সাধারণত গভীর নলকূপ বা নির্দিষ্ট কোনো পুকুরের পানি পান করে। কিন্তু এই নলকূপ এবং পুকুরের পানিতেও নোনা পানির প্রভাব পড়েছে। গোসল করাসহ সব কাজে এ এলাকার মানুষ যে পানি ব্যবহার করে তাতে লবণের পরিমাণ অনেক বেশি। এতে প্রচণ্ড স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির প্রতিদিন ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু উপকূলীয় এবং চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি ঢোকা অঞ্চলের মানুষকে প্রতিদিন ২০০ গুণের বেশি লবণ খেতে হচ্ছে; যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ছে আশঙ্কাজনক।
এমনিতেই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। দক্ষিণাঞ্চলের একটা বড় অংশ সমুদ্রের পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার ওপর কৃত্রিমভাবে তৈরি এ সংকটের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ হুমকিতে পড়েছে।
চিংড়ি চাষের শুরু থেকেই এ চাষবিরোধী অনেক আন্দোলন হয়েছে। চিংড়ি চাষের ফলে সাধারণ চাষিদের চরম সর্বনাশ হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
চিংড়ি চাষে লাভ আছে এটা ঠিক। কিন্তু এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তার দায় কে নেবে? এ জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার।
চিংড়ি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চিংড়ি রপ্তানি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয় এই শিল্প। তাই চিংড়ি চাষ বন্ধ করলে দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। এ কারণে চিংড়ি চাষ বন্ধ না করে চিংড়ি চাষের নতুন কোনো উপায় বের করতে হবে; যাতে নোনা পানি এলাকায় ঢুকানোর প্রয়োজন হবে না। স্বাদু পানিতে চাষযোগ্য চিংড়ির প্রজাতি যদি আনা সম্ভব হয়, তাহলে এটা হতে পারে সব থেকে বড় সমাধান।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এ সমস্যার প্রভাব সমগ্র দেশের ওপর পড়ছে। নোনা পানির কারণে কাজ হারানো মানুষ কাজের খোঁজে শহরে আসছে। এতে শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে। আবার অনেক বড় সংখ্যক মানুষের আয় কমে যাওয়ার ফলে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর পড়ছে। এই দিক বিবেচনা করে বলা যায় এ সমস্যা শুধু দক্ষিণবঙ্গের মানুষের নয় বরং সমগ্র দেশের। এ কারণে যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়