নিজস্ব প্রতিবেদক: পৃথিবীব যেসব দেশে সর্বনিন্ম কর-জিডিপি অনুপাত বিদ্যমান বাংলাদেশ সেই তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে। বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা বহুলাংশে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে ভ্যাট ও সম্পূরক করের মতো বিষয়ের ওপর রাজস্ব আহরণ বহুলাংশে নির্ভর করে। যে কর ব্যবস্থা কোনোভাবেই প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা নয়। একটি প্রগতিশীল ও বৈষম্য হ্রাসকরণমূলক কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে অবশ্যই প্রত্যক্ষ করা বাড়াতে হবে। আর প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে, বিভিন্ন স্থাবর সম্পত্তির ওপর করারোপ করা। কেননা সম্পত্তির মাধ্যমে যে আয় হয়, তার পরিমাণ মানুষের কর্মের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের তুলনায় অনেক বেশি। কাজেই এখান থেকে কর আহরণ করা না গেলে সমাজে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে যেমনটি ঘটছে।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে সম্পত্তি করের পরিস্থিতি ও সুযোগ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বিশেষ অতিথি ছিলেন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। প্যানেল আলোচক ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ও ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ, হিসাববিদ স্নেহাশীষ বড়–য়া এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। এছাড়া সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তারাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত রাষ্ট্রে সম্পত্তি করের পরিমাণ গড়ে ১০ শতাংশের ওপর। সেখানে বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ। ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর আহরণের পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ভুক্ত হবে। তখন নিজস্ব সম্পদ আহরণ বাড়াতে হবে। তাছাড়া দেশের মোট জিডিপির বিপরীতে প্রতিবছর দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর বিষয়ে আইএমএফের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে এখন কর আহরণের আওতায় বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সম্পত্তিকর। তবে এ সম্পত্তিকর আহরণের ব্যবস্থা হতে হবে ন্যায্য, স্বচ্ছ ও দক্ষতাসম্পন্ন। তিনি উল্লেখ করেন, সম্পদভিত্তিক আয়ের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। এ বৈষম্য হ্রাসকরণে শহরের সম্পদশালীদের ওপর করারোপের বিকল্প নেই।
উন্নয়ন প্রকল্পে কর ছাড় দেয়া হয় উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকার যখন নিজে কোনো প্রকল্প হাতে নেয়, সেটা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) হোক বা অন্য কোনো প্রকল্প, তখন দেখা যায়, তারা নিজেরাই কর পরিশোধ করে না। সরকার নিজেই যদি কর না দেয় তাহলে দেশের নাগরিকরা তো কর পরিশোধে নিরুৎসাহিত হবেনই। তিনি আরও বলেন, দেশে যদি জিডিপি ৬ শতাংশ নামিক প্রবৃদ্ধি হয় আর ৬ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয়, তাহলে চলতি মূল্যে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১২ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি বিবেচনা করা হলে প্রতিবছর সম্পদ কর খাত থেকেই বর্তমানে বাড়তি ছয় হাজার কোটি টাকার কর আহরণ হওয়ার কথা। কিন্তু কর আহরণের পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে আমরা সে কর আহরণ করতে পারছি না। তিনি উল্লেখ করেন, সম্পত্তি কর আহরণে বাংলাদেশ আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে।
এ সময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সম্পদ করের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। জমি ও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে কর আরোপ হচ্ছে না। এখানে বৈষম্য রয়েছে। জমির ওপর বিনিয়োগ বাড়ছে। কারণ জমির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এর বড় কারণ এ বিনিয়োগে বড় ধরনের কর দিতে হয় না।’
তিনি আর বলেন, ‘মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ছে, অথচ সেই অনুপাতে সম্পদের ওপর কর দিচ্ছে না। বিশেষ করে শত শত বিঘা জমি কিনে ফেলে রাখার বিষয়টি নজরে আনতে হবে। আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো দেশে জমি কিনে কেউ ফেলে রাখে না, বা রাখার সুযোগ নেই। কারণ অনুৎপাদনশীল জমির ওপর সেখানে উচ্চহারে ট্যাক্স আরোপ করা আছে। অথচ আমরা দেখতে পাই পূর্বাচলে শত শত প্লট ফাঁকা পড়ে আছে। এতে অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি উপকৃত হচ্ছে না।’ এ সময় তিনি জমি কিনে ফেলে রাখলে বাড়তি ট্যাক্স আরোপ করার সুপারিশ করেন। তাহলে জমির দামও অস্বাভাবিক হারে বাড়বে না। কারণ ট্যাক্সে চাপে আর কেউ জমি ফেলে রাখতে চাইবে না।
সিপিডি বলছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের অনুপাতে সম্পদ কর বাড়েনি। দেশের রাজস্ব আয়ের দুই-তৃতীয়াংশই আসে পরোক্ষ কর থেকে। গত ৫ বছর ধরে প্রত্যক্ষ কর আহরণ ৩৩ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। সম্পদ থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এটাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। তাই প্রত্যক্ষ কর আদায়ের জন্য নতুন নতুন খাত সন্ধান করতে হবে বলে মনে করে সিপিডি।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, কর্মসংস্থান ও করবিহীন উন্নত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। যেটা আসলে বেশিদিন টেকসই হবে না। বাংলাদেশ ঋণনির্ভর অনুন্নত অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। কোনো দেশে যদি গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও ভালো সেবা না থাকে, তাহলে সে দেশের মানুষ কর প্রদানে নিরুৎসাহিত হবেন, এটিই স্বাভাবিক। যে দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার হয় এবং সেই পাচারের সঙ্গে দেশের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আমলা ও রাজনীতিবিদরাও জড়িত। এমন একটি পরিস্থিতিতে মানুষ কর প্রদানে উৎসাহিত হবেন কেন?
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সহজ কাজটা সহজে করা যায় না। ভালো কাজ করতে গেলে একটি দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী বাধা দেয়। তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ভালো কাজ করতে দেয় না। তিনি আরও বলেন, জমি ক্রয় ও নিবন্ধন করতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। জনসাধারণ যখন দেখে যে, টাকা ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যায় না, তখন তারা ট্যাক্স দিতে চায় না।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা রয়েছে। রাতারাতি এ সমস্যা করা সম্ভব নয়। আমাদের জিডিপির তুলনায় ট্যাক্স আহরণ কম সেটা সত্য। কর আহরণ বাড়াতে সরকার ভূমির খাজনা আদায়ে ডিজিটাইজেশন পদ্ধতি চালু করছে। এতে রাজস্ব আহরণ বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, ভূমি অপরাধ আইনের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। শিগগিরই হয়তো সেটি জাতীয় সংসদে পাস হবে। এটি পাস হলে ভূমি খাতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে।