৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২০ হাজার কোটি টাকা

রোহান রাজিব:ব্যাংক খাতে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার ফলে ৮ ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। প্রথম প্রান্তিকে আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালানাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।

ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা না থাকার কারণে প্রথম প্রান্তিকে বিপুল পরিমাণ ঋণখেলাপি হয়েছে। যার কারণেই ব্যাংকগুলো প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। ঘাটতিতে পরা ব্যাংকগুলোকে ডেফারেল সুবিধা নিতে হয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকগুলোর একটা বড় সমস্যা। প্রভিশন ঘাটতি থাকলে মূলধনে গিয়ে প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ৮ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকায়। তিন মাস আগে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ১ হাজার ১১১ কোটি টাকা।

প্রথম প্রান্তিকে ঘাটতিতে পড়া তিন ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের তিনটি, বেসরকারি খাতের চারটি এবং বিশেষায়িত একটি ব্যাংক রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটিত দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে সরকারি বেসিক ব্যাংকের। মার্চ শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকায়। এরপর রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ১১ কোটি টাকা। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। ব্যাংকটি ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে।

বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে নানা সমস্যায় জর্জর ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির অঙ্ক ৭ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকা ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রভিশন ৩৬০ কোটি টাকা ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঘাটতি ১৬০ কোটি টাকা। এছাড়া বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) প্রভিশন ঘাটতির অঙ্ক ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৯২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭৬ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। ফলে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ১৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। তবে এ ঘাটতি ডিসেম্বর তুলনায় অনেক বেশি।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক যেসব ঋণ দেয়, তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ প্রভিশন সংরক্ষণের নিয়ম রাখা হয়েছে। ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিন্ম বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের দু’পক্ষের কাজ করতে হবে। মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আদায় করতে হবে। কারণ ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার সময় যাচাই-বাছাই ছাড়া দিয়েছে। তাই তারা আদায় করবে। তারা আদায় না করলে ব্যাংকের ক্ষতি হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খেলাপি ঋণ কমাতে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিতে হবে। যদি আদায় না করতে পারে তাদের বিভিন্ন সুবিধা বন্ধ করে দিতে হবে।

তিনি বলেন, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। ব্যাংক যদি প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা থাকে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের ওপর। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় আমানত। এসব সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করা উচিত। এ ধরনের কমিশনের মাধ্যমে এর আগেও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যাংক খাতে মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০২২ সালের একই সময় এর পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা।

দেশের ব্যাংক খাত উচ্চ খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। সেখানে মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশে। গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল ব্যাংক খাত সংস্কার করা। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে বিশেষ তাগিদ দেয় আইএমএফ, যাতে দেশের ব্যাংক খাত বড় ধরনের কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে।

আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০