বিশেষ প্রতিনিধি: ডলার সংকটে জ্বালানি তেল (বিশেষত ফার্নেস অয়েল) ও কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এতে ধুঁকছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। জ্বালানি সংকটে চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তার ওপর চলমান তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। এর মধ্যে ৩ জুন দিবাগত রাতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে। ওইদিন রাত ১২টা থেকে ৪ জুন রাত ১টা পর্যন্ত তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং ছিল।
যদিও গতকাল পর্যন্ত চালু ছিল দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে আজ যে কোনো সময় তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে লোডশেডিং আরও বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটির তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ১১ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। যদিও দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (আমদানিসহ) ২৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তবে জ্বালানি সংকটে সক্ষমতার বড় একটি অংশ বসে থাকছে।
তথ্যমতে, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয় ৩ জুন দিবাগত রাত ১২টায়। ওই সময় লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৮১ মেগাওয়াট। পরবর্তী এক ঘণ্টায় অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এতে (৪ জুন) রাত ১টায় লোডশেডিং করা হয় তিন হাজার ২৪ মেগাওয়াট। আর রাত দুইটায় লোডশেডিং করা হয় দুই হাজার ৯১২ মেগাওয়াট। এরপর তাপমাত্রা কমায় ধীরে ধীরে লোডশেডিং কমে আসে।
যদিও ৪ জুন সারাদিন উচ্চ হারে লোডশেডিং করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ভোর ৬টায় ও দুপুর ১টায় দুই হাজার মেগাওয়াটের কম লোডশেডিং হয়। তবে গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত বাকিটা সময় দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। এর মধ্যে সকাল ১০টায় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৭০৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
এদিকে ৩ জুন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল রাত ৯টায়। ওই সময় ১৩ হাজার ৬৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে দিনের অন্যান্য সময় এর পরিমাণ আরও কম ছিল। এর মধ্যে ৩ জুন সর্বনি¤œ উৎপাদন করা হয় সকাল সাড়ে ৮টায় ১১ হাজার ৩১০ মেগাওয়াট। আর ৪ জুন সকাল ১০টায় সর্বনি¤œ ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
জানতে চাইলে পিডিবির কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে কয়লা ও ফার্নেস অয়েল চাহিদামতো পাওয়া যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় চাহিদার তুলনায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। আর বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তাপমাত্রা কমছে না। এছাড়া হঠাৎ করেই কয়লা বা তেল সরবরাহও বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তাই সহসাই কাটছে না লোডশেডিংয়ের খ গ।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্বালানি পণ্যের অস্বাভাবিক দাম এবং প্রাপ্যতার অনিশ্চয়তার কারণেই লোডশেডিংয়ে মানুষের কষ্ট হচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল তিনি গণভবনে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বলেন, ‘করোনা ও যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানির দাম বেড়েছে। এই কারণে সাধারণ মানুষ লোডশেডিংয়ে কষ্ট পাচ্ছে। আমরা প্রত্যেক ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজকে বিশ্বব্যাপী গ্যাস, তেল, কয়লা সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়াতে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন টাকা দিয়েও জ্বালানি কেনা যাচ্ছে না, এরকম অবস্থা দাঁড়িয়েছে। যার জন্য আমি জানি এই গরমে মানুষের কত কষ্ট হচ্ছে। একদিকে দ্রব্যমূল্যস্ফীতি আর অপরদিকে বিদ্যুৎ নেইÑএই দুটো কষ্ট আমার দেশের মানুষ পাচ্ছে।’
এদিকে লোডশেডিং পরিস্থিতি ঠিক হতে আরও দুই সপ্তাহ লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন যাবৎ গ্রাহকেরা দেখছেন যে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। জ্বালানি হিসেবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেলের জোগান দিতে কষ্ট হচ্ছিল। এ কারণে লোডশেডিং ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে। লোডশেডিং পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে গেছে।
দেশের চলমান লোডশেডিং পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কত দ্রুত কয়লা নিয়ে আসা যায়, তার চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। দ্রুত সমাধানে বিদ্যুৎ বিভাগ চেষ্টা করছে।
তবে গত বছরের জুলাইয়ের মতো সূচি করে পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের চিন্তা আপাতত নেই বলে জানিয়েছেন নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, তাপপ্রবাহ চলছে, তাই বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে গেছে। আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।
পিডিবির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এর আগে দেশে সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছিল গত ১৩ মে। ঘূর্ণিঘড় মোখার কারণে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। এতে ওইদিন দুই হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। সেদিন দিবাগত রাত ১২টায় সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছিল।
এর আগে ১৫ এপ্রিল দুই হাজার ৫০৬ মেগাওয়াট সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল। ওইদিন সর্বোচ্চ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৯৬৩ মেগাওয়াট। তার আগে গত বছর ৮ অক্টোবর সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয় দুই হাজার ১০৭ মেগাওয়াট। সেদিন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ২৮৯ মেগাওয়াট।