লুণ্ঠনমুখী অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত ৩০ বছরে সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কাঠামোগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়ার কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। বিদ্যুতে যে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, তা থেকে দেশের উদ্যোক্তারা কোনো সুবিধা পান না। বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হয় চুরি করার জন্য। গুটিকয়েক মানুষকে সুবিধা দেয়ায় সরকার নীতি সিদ্ধান্তই পরিবর্তন করে ফেলছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি লুণ্ঠনমুখী ও মুনাফাখোর অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট সংলাপে গতকাল বক্তারা এ কথা বলেন। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে রাজধানীর লেকশোর হোটেলে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেকমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সামির সাত্তার, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম, শ্রমিক নেত্রী তাসলিমা আখতার লিমা প্রমুখ।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে দেশের অর্থনীতি চলছে ১ শতাংশ মানুষকে সুবিধা দিতে। যেসব স্বার্থগোষ্ঠী বর্তমান সরকারকে বিভিন্নভাবে ক্ষমতায় রাখতে সহযোগিতা করছে, সরকার তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে নানা নীতি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার না হওয়ায় দেশে কোনো সুশাসন ও জবাবদিহি নেই বলে অভিযোগ করেন তিনি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে তিনি বলেন, বহু বছর ধরে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। এরপর যখন সাম্প্রতিক চাপ এলো, তখন আর ডলারের দাম ধরে রাখা গেল না। ফলে এর প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। একদিকে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতি আমদানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রমাগত টাকা ছাপিয়ে যাচ্ছে। এটা আবার মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের অর্থ সরকার অপব্যবহার করেছে বলে দাবি করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ একটি সার্বভৌম তহবিল। কিন্তু এটি ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। রিজার্ভের টাকা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে (ইডিএফ) দেয়া

হয়েছে। ইডিএফে যত অর্থ দেয়া হয়েছে, তা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এমনকি ব্যাংক থেকে যারা বড় বড় ঋণ নিয়েছে, তারাও বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এ সরকার যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, তাই জনগণের কাছে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। যারা তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, সরকার তাদের সুবিধা দিতে ব্যস্ত।

বিএনপি নেতার এমন মন্তব্যের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সুশাসনের ভিত্তিতেই দেশ পরিচালনা করছে। আইনের বাইরে কিছু করছে না। কারও যদি মনে হয় আইনের বাইরে কিছু করছে, তাহলে তারা আদালতে যেতে পারেন। 

জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদও সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছরে এত পরিমাণ অর্থ লুট হয়েছে ও পাচার হয়েছে। কিন্তু কয়জন লোক শাস্তি পেয়েছে। দেশে আইনের শাসন থাকলে নির্বাচনসহ সবকিছু ঠিকভাবে চলত।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে যে ভর্তুকি দেয়া হয়, তা থেকে দেশের উদ্যোক্তারা কোনো সুবিধা পান না। এ থেকে এক ধরনের রেন্ট শিকার (মুনাফাখোর) গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হয় চুরিকে উৎসাহিত করার জন্য।’

এদিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা ধরনের চাপ আছে বলে মনে করছে সিপিডি। তারা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এই চাপগুলো মোকাবিলা করার তেমন কোনো দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। পাশাপাশি যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো প্রাক্কলিত করা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে অর্জন করা হবে তার দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি।

সিপিডির মতে, এই চাপগুলো হচ্ছেÑরাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট মেটানো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাত থেকে অতি ঋণ গ্রহণ করা, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি আয়ের কম প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ, কম রেমিট্যান্স প্রবাহ ইত্যাদি।

বাজেট সংলাপের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার প্রস্তাবিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে তা উচ্চাভিলাষী। আসলে এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখা সম্ভব হবে না। এছাড়া রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায় এবং বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হয়নি। তিনি আরও বলেন, বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাত থেকে অধিক ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এতে করে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সংকট কাটানোর কোনো উদ্যোগের কথা বলা নেই বাজেটে। বাজেটে বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়নি।

এ সময় সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ পূরণ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। দেশের আর্থিক খাতে আস্থার সংকট রয়েছে। এটি ব্যাংকিং এবং শেয়ারবাজার উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে। সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ গত ৫০ বছরে যেভাবে বাড়েনি, গত এক বছরে তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। আগামী অর্থবছরে টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের ঋণ জোগান দেয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেটি ঠিক হবে না। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, ‘দেশের খেলাপি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ব্যাংক খাতকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামষ্টিক অর্থনীতি আরও ক্ষতির মুখে পড়বে।’

এ সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল বলেন, আইএমএফ যে শর্তের কথা সরকারকে বলছে, তা নতুন কিছু নয়। আমরা এই কথাগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম। সরকার তা এতদিন গুরুত্ব দেয়নি। এখন তারা আইএমএফের কথা শুনে গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ দেশের মানুষের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা নেই। তাদের দায়বদ্ধতা থাকলে তারা গুরুত্ব দিত। তিনি আরও বলেন, সরকার যে বাজেটটি করেছে, সেখানে সাধারণ মানুষের কথা ভাবা হয়নি।

অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বাজেটে এ সমস্যা সমাধানে খুব বেশি জোর দেয়া হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির লুণ্ঠনমুখী মূল্যহারের নামে ৪০ হাজার কোটি টাকা অযৌক্তিক ব্যয় করা হয়েছে। তারা এখন মাসে ৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে। এটা সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বড় বাজেট দিয়ে বেপরোয়া কর আরোপ করা হচ্ছে। এতে সরকার খুশি হলেও আমরা আতঙ্কিত।

সংলাপে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সামাজিক স্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতা না থাকলে উন্নতি সম্ভব নয়। মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ায় ২০ বছর ক্ষমতায় থাকলে ভালো লাগে, লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরে ৪০ বছর ক্ষমতায় থাকলে ভালো লাগে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ১০ বছর ক্ষমতায় দেখতে ভালো লাগে না। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও রাশেদ খান মেননসহ যারা যারা খেলতে চান মাঠে নামুন। গ্যালারিতে বসে খেলতে পারবেন না, মাঠে নামুন।’

সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখন বাজেট সংসদীয় কমিটিতে যায় না। সংসদেও আলোচনা তেমন হয় না। এর ফলে বাজেটের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সংকটময় সময়ে চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না গেলে আগামীতে অর্থনীতিতে সমস্যার সৃষ্টি হবে। বাস্তবতা বিবেচনা করেই সব কিছু চিন্তা করা উচিত।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০