বিশেষ প্রতিনিধি: পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়েছিল গত বছর ২৫ জুন। পরের দিন (২৬ জুন) সকাল ৬টা থেকে সাধারণ মানুষের পারাপারের জন্য তা খুলে দেয়া হয়। এর প্রায় এক বছর পর এসে সেতুটির মূল অবকাঠামোর নির্মাণব্যয় বাড়তে যাচ্ছে। আজ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এ প্রস্তাব উঠবে। এতে সেতুটির নির্মাণব্যয় বাড়বে প্রায় ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। চায়না মেজর ব্রিজ করপোরেশন সেতুটির নির্মাণশেষে বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
সূত্রমতে, ২০১৪ সালের ১৭ জুন চায়না মেজর ব্রিজের সঙ্গে সেতুটি নির্মাণে চুক্তি সই হয়। সে সময় চুক্তিমূল্য ছিল ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বাড়ছে এক হাজার ৫২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে অতিরিক্ত ভ্যাট ও আয়কর বাবদ ব্যয় বাড়ছে ৪০৭ কোটি ৬৩ লাখ এবং নির্মাণব্যয় নিট বৃদ্ধি পেয়েছে এক হাজার ১১৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সাতটি কারণে মূল সেতুর নির্মাণব্যয় বাড়ছে। এর মধ্যে ঠিকাদারের কাজ অতিরিক্ত ৪৩ মাস সময় বৃদ্ধিজনিত কারণে ১৩৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল সেতুর ২২টি পিয়ারের ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে ৬টি পাইলের পরিবর্তে ৭টি পাইল করার প্রয়োজন হয়। ২২টি পাইল বৃদ্ধির কারণে ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। মাওয়া প্রান্তের মাটির লিকুইফিকেশন সমস্যা থাকায় ভূমিকম্পজনিত ক্ষতি প্রতিরোধের জন্য ভায়াডাক্টের পাইলে স্কিন গ্রাউটিং করার জন্য ব্যয় বেড়েছে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
এর বাইরে ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইনের টাওয়ারের ফাউন্ডেশন প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের জন্য ব্যয় বেড়েছে ৪০৭ কোটি টাকা। মূল সেতুর কাজের সময় বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠিকাদারের বিদেশ থেকে আমদানি করা বৃহৎ আকৃতির ক্রেন, হ্যামারগুলো প্রকল্প এলাকায় ৪৩ মাস অতিরিক্ত অবস্থান করেছে। ফলে যন্ত্রপাতির ভাড়া, ওয়েটিং চার্জ, ব্যবস্থাপনা খরচ ইত্যাদি কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৭০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। চুক্তিকালীন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৮.৩০ টাকা। প্রতি বছর ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে ঠিকাদারের বৈদেশিক মুদ্রায় অতিরিক্ত ১০৫ কোটি ৪ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধের জন্য ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এছাড়া সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে ভ্যাট ও আয়করের হার ১০.৫০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩১০ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
উল্লিখিত আইটেমগুলোয় ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল সেতু নির্মাণে মোট এক হাজার ৮৭৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বৃদ্ধি পায়। তবে বেশ কয়েকটি বিলে ৩৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা খরচ কমেছে। এতে সার্বিকভাবে ব্যয় বাড়ছে এক হাজার ৫২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, মূল সেতুর চুক্তি মূল্যের মধ্যে বাংলাদেশি মুদ্রায় ছিল তিন হাজার ১০৬ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ২৫৫ টাকা (২৫.৬০ শতাংশ) এবং বৈদেশিক মুদ্রায় ১১৫ কোটি ২৯ লাখ ৪ হাজার ৭৮২ ডলার (৭৪.৪০ শতাংশ)। তবে সংশোধিত চুক্তি মূল্যের মধ্যে বাংলাদেশি মুদ্রায় পাঁচ হাজার ৪৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩২৫ টাকা (৩৯.৭৯ শতাংশ) এবং বৈদেশিক মুদ্রায় ১০৫ কোটি ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১৩১ ডলার পরিশোধ করতে হবে।
সূত্র জানায়, উদ্বোধনের পর থেকে গত মঙ্গলবার (২০ জুন) পর্যন্ত সেতুটি দিয়ে যানবাহন পারাপার হয়েছে ৫৫ লাখ ৯০ হাজার ৬০৭টি। আর এ সময় (৩৬০ দিন) সেতুটি থেকে টোল আদায় হয়েছে ৭৮৫ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার ৩৫০ টাকা। এছাড়া এ পর্যন্ত চার কিস্তিতে সেতুটির ঋণের ৬২২ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৪২ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহে দেয়া হয়েছে ৩১৬ কোটি দুই লাখ ৬৯ হাজার টাকা। আর গত এপ্রিলে দেয়া হয়েছিল ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের মধ্যে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে। এ ঋণ পরিশোধে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট চুক্তি সই করে সেতু কর্তৃপক্ষ ও অর্থ বিভাগ। ঋণচুক্তি অনুযায়ী, সেতু কর্তৃপক্ষ ৩৫ বছরে এক শতাংশ সুদে এ ঋণ পরিশোধ করবে। এতে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট প্রথম পদ্মা সেতু প্রকল্প অনুমোদন হয়, যা ছিল শুধু সড়ক সেতু। সে সময় নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তবে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম সংশোধন করা হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পটি, সে সময় রেলপথ যুক্ত হয়। ওই সময় দু’তলা সেতুর নির্মাণব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। সব অংশের ঠিকাদার নিয়োগের পর সেতুটির নির্মাণব্যয় বেড়ে যায়। এতে ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফা প্রকল্প সংশোধন করা হয়। এতে নির্মাণব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
জমি অধিগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য ২০১৮ সালের ২১ জুন বিশেষ সংশোধনে ব্যয় আরও বেড়ে হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। মূলত ড্রেজিং স্পয়েল ফেলার জন্য চর অধিগ্রহণে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়। তবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রায় ১০ মাস পর গত ২৩ এপ্রিল তৃতীয় দফা সংশোধন করা হয় প্রকল্পটি। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা।