হামিদুর রহমান: আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে দিন দিন তাপমাত্রা বাড়ছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। এই তাপমাত্রায় প্রভাব পড়ছে ওষুধে। বিভিন্ন ফার্মেসিতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ না হওয়ায় কার্যকারিতা হারাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিষেজ্ঞরা।
তাদের মতে, দেশের আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তন হলেও অনেক ফার্মেসি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণে প্রস্তুত নয়। এ অবস্থায় অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের গুণগত মান কমে যাওয়া, এমনকি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
দেশের অনেক জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানেও ওষুধ সংরক্ষণে শতভাগ নিয়ম মানা হয় না বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
বাজারে কিছু ওষুধের নির্দেশিকায় বা মোড়কে ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখার নির্দেশনা রয়েছে, যা বর্তমান আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়। কিছু মডেল ফার্মেসি ছাড়া বেশিরভাগ ফার্মেসিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। আবার দোকান বন্ধ থাকা অবস্থায় ওষুধের তাপমাত্রায় আরও ব্যাঘাত ঘটায়।
উল্লেখ্য, আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায় অবস্থান করছে। আবার দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও অবস্থান করছে। গত ১৪ এপ্রিল রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।
রাজধানীর পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ ওষুধের দোকানে রেফ্রিজারেটর নেই। ওষুধের দোকানগুলোয় এ ব্যবস্থা না থাকায় ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। আবার অনেক দোকানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অনেক সময় রোগীর ভোগান্তিও বেড়ে যায়।
ফার্মেসিগুলোতে দেখা যায়, বিশেষ কিছু ওষুধ রেফ্রিজারেটরে রাখা হলেও বেশিরভাগ ওষুধ শেলফেই রাখা হচ্ছে। যেখানে তাপমাত্রার কোনো বালায় নেই। জ্বর, সর্দি-কাশি ও ডায়রিয়া, মাথা ও শরীর ব্যথার মতো ওষুধগুলো সাধারণত সেলফে থাকে। যেগুলোর তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
জানা যায়, স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণযোগ্য ওষুধও গরমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেশের বাজারে প্রচলিত ওষুধের প্রায় ৯০ শতাংশই ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণযোগ্য। এসব ওষুধ ঠাণ্ডা ও শুকনো স্থানে আলোর আড়ালে রাখতে হয়। গরমের সময় দেশের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও তা অনেক সময় ৪০ ডিগ্রিও অতিক্রম করছে।
২০ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে যেসব ওষুধ রাখা হয় রোপিডর ৫, লিনাডাস ৫, ক্যালনর, হাইপেন এসআর, লার্ব ২৫, ট্রাইলক ৫, পেপটিল ২০, অ্যানসেট ৮, মেট ৫০০, ওপসোনিল ১০০, নাপা, সোডিনেট, প্রিগ্যবা ৭৫, মেভ, ডমিন, অ্যানজিটর, ফ্ল্যাকোল, সেডনো, মেভিন, ফ্যামোটেক ২০, (ট্রাইপটিন ২০) নেক্সাম ২০ প্রভৃতি ওষুধ রাখা হয়।
এছাড়া ইনসুলিন, অ্যান্টিবায়োটিক তরল, ইনজেকশন, চোখের ড্রপ ও কিছু ক্রিম অবশ্যই ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে।
হƒদরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘হƒদরোগের ওষুধগুলো সাধারণত একটু স্পর্শকাতর। এগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় না রাখলে ওষুধের কার্যকারিতা থাকে না। তাপমাত্রার যে অবস্থা এখনই যদি সচেতন হওয়া না যায় সামনে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়বে।
জানতে চাইলে একুশে পদকপ্রাপ্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা না গেলে ওষুধের গুণগত মান থাকে না বা কার্যকারিতা হারিয়ে যায়। কিছু ওষুধ অনেক বেশি স্পর্শকাতর, যেগুলো রেফ্রিজারেটর করতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক, বিভিন্ন ধরনের হরমোন, ব্লাড প্রডাক্ট যেগুলো বায়োসিমিউলেশন প্রডাক্ট অর্থাৎ বায়োমলিকুলার ওষুধগুলো উচ্চতাপমাত্রায় নষ্ট হয়ে যায়। সচেতনতার জন্য বেশি বেশি প্রচারণা চালাতে হবে। সবাইকে সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ রাখার পরাশর্ম দিতে হবে।’
ওষুধ প্রশাসনের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা বিষয়গুলো লক্ষ্যে করছি। বর্তমানে মেডিসিন লাইসেন্সের কয়েকটি শর্তের মধ্যে শীতাতপসহ অন্য বিষয়গুলো গুরুত্ব দিচ্ছি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে স্থানীয়ভাবে ওষুধ উৎপাদন হয় প্রায় ৯৮ শতাংশ। বর্তমানে ২৯৫টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার বেশি ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করে। এছাড়া ২০৫টি আয়ুর্বেদিক, ২৮৪টি ইউনানি ও ৩৮টি হারবাল, ৭১টি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বছরে হাজার কোটি টাকারও বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে। ৩১ হাজার ওষুধ রয়েছে অ্যালোপ্যাথিকের। এসব ওষুধ প্রায় ৪০০ মডেল ফার্মেসি, ৩২ হাজার মডেল মেডিসিন শপসহ মোট ২ লাখ ২ হাজার ৫২৮টি ওষুধের দোকানের মাধ্যমে বাজারজাত করা হচ্ছে; যার বেশিরভাগ ওষুধই সংরক্ষণ করতে হয় ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তবে মডেল ফার্সেসিগুলোয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করলেও পাড়া-মহল্লার ফার্মেসিগুলোয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কোনো বালাই নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ওষুধের গুণগত মান ঠিক রাখতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রার বিকল্প নেই। অনেক ওষুধ এখন বায়োমলিকুলার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হলো এ ওষুধগুলো একটু বেশি তাপমাত্রা পেলেই নষ্ট হয়ে যায়। কিছু মডেল ফার্মেসি ব্যতীত বেশিরভাগই সাধারণ ফার্মেসি। সাধারণ ফার্মেসিগুলোয় যথাযথ তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণের জন্য ওষুধ প্রশাসনকে বেশি বেশি অভিযান পরিচালনা করতে হবে।’