নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা রাজনৈতিক। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাতে লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। আর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। যত আইন করা হোক, কোনো লাভ নেই, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে।
ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সংকট কেন, সমাধান কীভাবে?’ শীর্ষক ওয়েবিনারে গতকাল শনিবার বক্তারা এসব কথা বলেন।
ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষক জাহেদ উর রহমানের সঞ্চালনায় এতে আলোচক ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম, পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ও সিটিব্যাংক এনএ’র সাবেক প্রধান নির্বাহী মামুন রশীদ এবং প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প গবেষক জিয়া হাসান এতে সমাপনী বক্তব্য দেন।
মইনুল ইসলাম বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাতে লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। আমার ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ’ শীর্ষক এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছি, ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হয়েছে। ২০১০ সালে এ গবেষণা বই আকারে বেরিয়েছে, যা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি উৎসাহিত করা। তাদের বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে খেলাপি হতে উৎসাহিত করছে সরকার। বর্তমান অর্থমন্ত্রী যোগ দেয়ার পর এ প্রবণতা আরও বেশি হয়েছে। তিনি একটার পর একটা আইন পরিবর্তন করে খেলাপিদের সুবিধা তৈরি করে দিয়েছে। আর সর্বশেষ সংযোজন হলো ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে সুবিধা দেয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেয়, তা যথাযথ নয় বলে মন্তব্য করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর অর্ধেকের মতো বছরের পর বছর ধরে মামলায় ঝুলে আছে। অর্থাৎ যত দিন মামলাগুলো চলবে, তত দিন খেলাপি হিসেবে এগুলোকে গণ্য করা হবে না। একইভাবে অবলোপন করা ৫৫ হাজার কোটি টাকাকেও খেলাপি হিসেবে দেখানো হয় না। এ দুটিকে যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় চার লাখ কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশের বর্তমানে ব্যাংক খাতের যে দুর্দশা, তারপরও সংকট দেখা দিচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নে মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষ রেমিট্যান্স পাঠায়। সেটা ব্যাংকের আমানত হিসেবে জমা হয়। তাই ব্যাংকে আমানতের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এসব আমানত থেকে ঋণ নিয়ে লুটপাট করা হচ্ছে। ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। ফলে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হচ্ছে বেশি। পুরোটা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রভাবে। খেলাপি ঋণের বড় অংশই পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, পাচারকৃত অর্থের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী ব্যবস্থা করেছিলেন সাত শতাংশ কর দিয়ে সেই অর্থ ফেরত আনা, তা কাজে দেয়নি। একটি পয়সাও ফেরত আসেনি। পুঁজি পাচার নিয়ে অর্থমন্ত্রী একেবারেই নরম অবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। পুঁজি পাচারই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের জন্য দায়ী। এদিকে টাকার মান কমেছে ২৫ শতাংশ, যার কারণে মূল্যস্ফীতির তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। সারা দেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে খারাপ অবস্থা, এর পেছনে ব্যাংক খাতে লুটপাটের কারণও দায়ী।
মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছে। এমন একটি দেশের নামও কেউ বলতে পারবেন না, যেখানে একটি গ্রুপের হাতে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কোনো সভ্য দেশের সরকার তা মেনে নিতে পারে না।
পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশীদ বলেন, ব্যাংক খাতের সমস্যা শুধু খেলাপি ঋণ নয়, সুশাসন ও জবাবদিহির অভাব। আমাদের অর্থনীতি বড় হওয়ার পরও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত হয়নি। আমাদের ব্যাংক খাতে নতুন পণ্য আসছে না। এগুলো ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা।
জবাবদিহির অভাবের উদাহরণ দিতে গিয়ে মামুন রশীদ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে রিজার্ভ পাচার হয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও ২৮ বার এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যাংকের পরিচালক নেই। তারা ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টরদের মাধ্যমে ব্যাংক চালাচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতার ৫২ বছরেও একটা ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর গাইড লাইন তৈরি করতে পারিনি। ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর নিয়োগ হচ্ছে, সব পরিচালকদের আত্মীয়স্বজন।
প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন জয়নুল হক সিকদার। মারা যাওয়ার পর তার দুই ছেলে ব্যাংকে প্রায় পারিবারিক রাজস্ব কায়েম করেন। একজনের পর একজন এমডি এসেও এ ব্যাংকে থাকতে পারেননি। আরেক ব্যাংকের এমডিকে গুলি করার চেষ্টা করা হয়েছে। নিজেদের ব্যাংকের এমডিকে গায়ে হাত তোলার অভিযোগও আছে। হয়তো শেষ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যাপার ছিল। নইলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাদের ডেকে বলা হতো নাÑএভাবে আর চলতে দেয়া যাবে না।
শওকত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে ব্যাংক খাতের সমস্যা সামাধান করা সম্ভব। কিন্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে নেই। একটি গ্রুপের সাতটি ব্যাংক গত সাত মাস সিআরআর রাখতে পারছে না। তাদের তারল্য ব্যবস্থা ভয়াবহ খারাপ। শুধু প্রভাবশালী ব্যাংক হওয়ায় কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এছাড়া বেনামি ঋণ বেড়ে হচ্ছে ওই সব ব্যাংক থেকে। তার আত্মীয়স্বজন এসব ঋণ বের করছে। তবুও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উল্টো তাদের টাকা ধার দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন একেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে একেক রকম।
জিয়া হাসান বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতের প্রধান সংকট রাজনৈতিক। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।