পায়রা-রামপালের চেয়ে আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল কম

ইসমাইল আলী: ৬ এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে ভারতের আদানি পাওয়ার। গত ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির (বিআইএফপিসিএল) রামপাল কেন্দ্রটি। ২০২০ সালের মে থেকে নিয়মিত উৎপাদন করছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাভিত্তিক এ তিন কেন্দ্রের মধ্যে গত এপ্রিলে সবচেয়ে কম উৎপাদন ব্যয় ছিল আদানির। আর সবচেয়ে বেশি ব্যয় পায়রায়।

যদিও উৎপাদন শুরুর আগে থেকেই আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দেয়। কারণ এ কেন্দ্রটির জন্য কয়লার দাম ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে অনেক বেশি। আদানির প্রস্তাবিত সেই দামে বিদ্যুৎ কিনতে অস্বীকৃতি জানায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ নিয়ে দুই পক্ষের চিঠি চালাচালি ও দরকষাকষির পর পায়রা-রামপালের চেয়ে কিছুটা কমে বিদ্যুৎ বিক্রিতে সম্মত হয় আদানি। গত ১ জুলাই এক চিঠিতে এ তথ্য জানায় আদানি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি আদানি থেকে এপ্রিল মাসে বিদ্যুৎ কেনার বিল চূড়ান্ত করেছে পিডিবি। এতে দেখা যায়, এপ্রিলে পায়রা ও রামপালের তুলনায় আদানির বিদ্যুৎ কিনতে গড়ে ব্যয় কম হয়েছে।

তিন কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যয়ের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে পরিচালিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। এপ্রিলে এর সক্ষমতার (প্লান্ট ফ্যাক্টর) ৭১ দশমিক ৪৪ শতাংশ ব্যবহƒত হয়েছে। ফলে ওই মাসে কেন্দ্রটি গড়ে ৯৭৪ দশমিক ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এতে এপ্রিলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন হয় ৭০ কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭১ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ।

ওই মাসে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি ব্যয় ছিল প্রায় ৯০৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ৪০৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় পড়ে এক হাজার ৩১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৮ টাকা ৬৮ পয়সা। এর মধ্যে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পাঁচ টাকা ৭৯ পয়সা। আর গড় জ্বালানি ব্যয় পড়ে ১২ টাকা ৮৯ পয়সা।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল (এক ইউনিট) ৬১৭ মেগাওয়াট। তবে কয়লা সংকটে এর অর্ধেক প্রায় পুরো সময়ই বসে ছিল। ফলে এপ্রিলে রামপালের সক্ষমতার (প্লান্ট ফ্যাক্টর) মাত্র ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ ব্যবহƒত হয়। অর্থাৎ ওই মাসে কেন্দ্রটি গড়ে ১৬২ দশমিক ৯৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এতে এপ্রিলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন হয় ১১ কোটি ৭৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৮০ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ।

ওই মাসে রামপালের জ্বালানি ব্যয় ছিল প্রায় ১২৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ও ক্যাপাসিটি চার্জ ৪৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৭৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১৪ টাকা ৮৫ পয়সা। এর মধ্যে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ চার টাকা ২১ পয়সা ও গড় জ্বালানি ব্যয় ১০ টাকা ৬৪ পয়সা।

এদিকে আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। তবে এপ্রিলে শুধু প্রথম ইউনিটটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। এতে এপ্রিলে আদানির সক্ষমতার ব্যবহার (প্লান্ট ফ্যাক্টর) হয় ৩৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফলে ওই মাসে কেন্দ্রটি গড়ে ৬০৯ দশমিক ৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এতে এপ্রিলে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন হয় ৪৩ কোটি ৮৭ লাখ ৯৪ হাজার ১৮৯ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ।

ওই মাসে আদানির জ্বালানি ব্যয় ছিল প্রায় ৪০৫ কোটি ২১ লাখ ও ক্যাপাসিটি চার্জ ১৮১ কোটি ৯ লাখ টাকা এবং অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় চার কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে মোট উৎপাদন ব্যয় ৫৯১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১৩ টাকা ৪৭ পয়সা। এর মধ্যে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ চার টাকা ১৩ পয়সা ও গড় জ্বালানি ব্যয় ৯ টাকা ২৩ পয়সা।

তিন কেন্দ্রের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, এপ্রিলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় আদানির জ্বালানি ব্যয় ছিল গড়ে তিন টাকা ৬৬ পয়সা কম। এমনকি রামপালের তুলনায়ও আদানির জ্বালানি ব্যয় এক টাকা ৪১ পয়সা কম। এছাড়া আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পায়রার তুলনায় ইউনিটপ্রতি এক টাকা ৬৬ পয়সা কম। অর্থাৎ পায়রার তুলনায় আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিটে পাঁচ টাকা ২১ পয়সা কম।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ব্যয় পায়রার তুলনায় অনেক বেশি ধরা হয়েছিল প্রাথমিকভাবে। তবে গত ডিসেম্বরে এ নিয়ে আপত্তি তুলে চিঠি দেয়া হয়। এরপর দুই পক্ষের দরকষাকষির পর আদানি জ্বালানি তথা কয়লার দাম কম রাখতে সম্মত হয়। গত ১ জুলাই এক চিঠিতে এ প্রসঙ্গে আদানি জানায়, বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে পরিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির জ্বালানি ব্যয় দশমিক শূন্য এক সেন্ট (০.০১) কম রাখা হবে। প্রতি মাসে এ দাম সমন্বয় করা হবে বলেও চিঠিতে জানানো হয়।

তারা আরও বলেন, এপ্রিলের বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ডলারের বিল জমা দিয়েছিল আদানি। তবে দরকষাকষির পর তা ৫৩ মিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়। এতে এপ্রিলে বিদ্যুৎ কেনার দাম অনেক কম পড়েছে। তবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আগে কেনা ছিল। তাই তাদের জ্বালানি বিল বেশি পড়েছে। আগামীতে পায়রার বিলও কমে আসবে।

প্রসঙ্গত, আদানির বিদ্যুতের উচ্চ দাম নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে শেয়ার বিজ। এর মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি ‘কয়লার দাম ধরা হয়েছে ৪২% বেশি: আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকা!’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে আদানিসহ দেশের পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক বিবরণ তুলে ধরা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি ছাপা হয় ‘চুক্তি সংশোধন চেয়ে চিঠি: কয়লার দাম না কমালে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে না বাংলাদেশ!’। আরও বেশকিছু প্রতিবেদন ছাপানো হয় আদানির বিদ্যুৎ কেনা নিয়ে। সর্বশেষ ১২ জুলাই ছাপা হয়েছে ‘পায়রা-রামপালের চেয়ে জ্বালানি বিল কম রাখবে আদানি!’।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০