খেলাপিযোগ্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত দেখাচ্ছে ট্রাস্ট ব্যাংক!

রোহান রাজিব: পুনর্গঠিত ঋণের টানা দুটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী খেলাপি হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ট্রাস্ট ব্যাংকের গ্রাহক মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেড টানা তিন কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। তবু প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত দেখাচ্ছে ট্রাস্ট ব্যাংক। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক মডার্ন স্টিল মিলসের ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছে ব্যাংকটিকে। চিঠি পাওয়ার সাত কর্মদিবসের মধ্যে খেলাপি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে জানাতেও বলা হয়।

জানা যায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বড় ঋণখেলাপিদের বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিয়ে একটি নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিয়েও এসব গ্রুপের কাছ থেকে খেলাপি ঋণের তেমন কোনো অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়নি। উল্টো কয়েকটি গ্রুপ নতুন করে আরও ঋণ নিয়েছে। এছাড়া অর্থ আদায় করা সম্ভব না হলেও ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের সুবিধা করে দিচ্ছে। খেলাপিযোগ্য ঋণও খেলাপি করছে না ব্যাংক। এমন ঘটনা ঘটেছে ট্রাস্ট ব্যাংকের ক্ষেত্রেও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নীতিমালায় বলা হয়, পুনর্গঠিত ঋণ আর পুনঃতফশিল করা যাবে না। সুবিধা নেয়া কোনো প্রতিষ্ঠান সময়মতো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সব ধরনের সুবিধা বাতিল হবে। টানা দুটি কিস্তি না দিতে পারলে ঋণ খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া টানা দুটি কিস্তি খেলাপি হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমুদয় অর্থ আদায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক দেউলিয়া আইনে মামলা করতে পারবে। তবে সুবিধা পাওয়া অনেক প্রতিষ্ঠান বেশ আগে খেলাপি হলেও দেউলিয়া আইনে মামলা করার খবর পাওয়া যায়নি।

দেখা যাচ্ছে, বিশেষ সুবিধা নেয়ার পরও ট্রাস্ট ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না মডার্ন স্টিল মিলস। অর্থ পরিশোধ না করেও প্রতিষ্ঠানটিকে সুবিধা এবং ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ করে দিচ্ছে ব্যাংকটি, যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম সরাসরি লঙ্ঘন করা হয়েছে।

ট্রাস্ট ব্যাংকে পাঠানো চিঠি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ট্রাস্ট ব্যাংক ২০১৫ সালে মডার্ন স্টিল মিলসের ৮৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকার একটি ঋণ পুনর্গঠন করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের বকেয়া স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫১ কোটি টাকায়। গ্রাহকের ঋণের বিপরীতে গত বছরের সেপ্টেম্বর, ডিসেম্বর ও চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে কোনো অর্থ আদায় করতে পারেনি ট্রাস্ট ব্যাংক। টানা তিন কিস্তি কোনো অর্থ আদায় না করতে পারলেও মডার্ন স্টিল মিলসকে খেলাপি না করে ঋণ নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংকটি। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডির ২০১৫ সালের ৪নং সার্কুলারের ৩ (জি)-এর নির্দেশনা সরাসরি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এছাড়া বিআরপিডির অন্য এক প্রজ্ঞাপনে কিস্তির বিপরীতে ন্যূনতম ৬০ ও ৫০ শতাংশ অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলেও যথা নিয়মে ঋণ হিসাব খেলাপি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে নির্দেশনা অমান্য করে ট্রাস্ট ব্যাংক মডার্ন স্টিল মিলসের ঋণ নিয়মিত রেখেছে।

ঋণ হিসাব যথাযথ মানে শ্রেণিকরণ না করায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানো হয়েছে বলেও চিঠিতে বলা হয়। তাই ব্যাংকটিকে প্রতিষ্ঠানের ঋণটি খেলাপি করে সাত কর্মদিবসের মধ্যে জানাতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে ব্যাংকটির পুনর্গঠিত ঋণের ২২ কোটি ১৭ লাখ টাকা খেলাপি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়রা আজম ব্যস্ততার কথা বলেন। পরবর্তীকালে কখন যোগোযোগ করতে হবেÑজানতে চাইলেও তিনি উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।

ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিস্থিতি চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ২৫ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে দুই হাজার ২৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ট্রাস্ট ব্যাংকের চলতি ২০২৩ হিসাববছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) আগের হিসাববছরের একই সময়ের তুলনায় কর-পরবর্তী নিট মুনাফা কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ব্যাংকটির চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ট্রাস্ট ব্যাংকের জানুয়ারি-জুন সময়ে কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ১৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা, আগের হিসাববছরের একই সময়ে যা ছিল ১৫৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির সমন্বিত নিট মুনাফা কমেছে ২৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা বা ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকের সমন্বিত শেয়ারপ্রাতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১ টাকা ৭৭ পয়সা, আগের হিসাববছরের একই সময়ে যা ছিল ২ টাকা ১৫ পয়সা।

সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০২২ হিসাববছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য মোট ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০