বিশেষ প্রতিনিধি:হঠাৎ করেই দেশের বাজারে ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ না থাকায় ব্যবসায়ীদের কারসাজি খুঁজতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানে নেমেছে সরকার। যদিও এতে তেমন কাজ হচ্ছে না। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) দাবি, করপোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট মূলত ডিমের দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী। গত বছর আগস্টেও তারা সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়িয়ে ছিল। এ বছরও তারা একই খেলায় মেতেছে।
বর্তমানে বাজারে বাদামি ডিমের হালি এখন ৬০ টাকা। আর সাদা ডিম ৫৫ টাকা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। পাইকারিতেই বাদামি ডিমের শ’ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩১০ থেকে এক হাজার ৩২০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে ১৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১৩ টাকা ২০ পয়সা। এতে হালি হিসেবে করলে আসে ৫২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৫২ টাকা ৮০ পয়সা। আর আড়তে ১০০ সাদা ডিমের এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও যে দামটা ছিল এক হাজার ৮০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্ষায় খামারিদের ক্ষতি হয় বলে প্রতি বছর এই সময় ডিমের দাম কিছুটা বাড়ে। তবে এবার দাম বৃদ্ধি আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ডজন হিসেবে ডিমের দাম উঠেছে ১৬৫-১৭০ টাকায়। আর ঢাকার খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম ১৪ থেকে ১৫ টাকা।
যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে ডিমের দাম বাংলাদেশের চেয়ে অর্ধেক। অনলাইন ইন্ডিয়ার তথ্যমতে, ভারতের মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, আহমেদাবাদ, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, বিশাখাপত্তমসহ সব বড় শহরেই প্রতি পিস মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ছয় রুপিতে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় আট টাকা। আর বেজলাইন ডটপিকের তথ্যমতে, পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে প্রতি ডজন ডিমের দাম ২৪০ পাকিস্তানি রুপি। অর্থাৎ প্রতিটি ডিমের দাম ২০ রুপি বা সাড়ে ৭ টাকা।
বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার এ প্রসঙ্গে জানান, বাংলাদেশে প্রতিদিন সব ধরনের ডিমের মোট চাহিদা চার কোটি ৫০ লাখ পিস। আর উৎপাদন আছে পাঁচ কোটির মতো। অর্থাৎ দেশে ডিমের উৎপাদন হঠাৎ করে কমে যায়নি, যে দাম এতটা বেড়ে যাবে। তবে পোলট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। তারপরও খুচরা পর্যায়ে একটি ডিম এখন কোনোভাবেই ১৩ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
তিনি বলেন, আসলে ডিমের বাজার খামারিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তারাই ঠিক করে দেয় ডিমের দাম। প্রতিদিন সকালে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকজন ডিমের দাম ঠিক করে দেয়। আর সেই দামেই সারাদেশে ডিম বিক্রি হয়। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারা তাদের নির্দিষ্ট এজেন্টদের মাধ্যমে সকাল ১০টার মধ্যে মোবাইল ফোনের এসএমএস, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সারাদেশে ডিমের দাম জানিয়ে দেয়। সেই দামেই বিক্রি হয়। এর সঙ্গে উৎপাদন বা চাহিদার তেমন সম্পর্ক থাকে না।
প্রসঙ্গত, গত বছরের আগস্টেও একইভাবে ডিমের বাজারে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়। তখন ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ও তদন্ত করে কাজী ফার্মসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ডিমের বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর প্রমাণ পায়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। তবে সে উদ্যোগ থেমে যায় ওই পর্যন্তই। সেসব মামলায় কোনো ফল হয়নি। কাউকে শাস্তির আওতায়ও আনা যায়নি। এতে আবারও সিন্ডিকেট মাথাচাড়া দিয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিপিএ’র তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন পোলট্রি খামারি আছে ৬০ হাজার। তাদের মধ্যে ২০ হাজার খামারি ডিম উৎপাদন করেন। আর ৪০ হাজার খামারি মুরগি উৎপাদন করেন। এই ৬০ হাজার খামারের মধ্যে ১৯ হাজার খামারিকে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় নিয়ে গেছে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এটা দাদন ব্যবসার মতো। তাদের আগাম টাকা দিয়ে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দেয়া হয়। সারা বছর সেই একই দামে ডিম ও মুরগি কেনে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান। দেশে মোট খামারের তিন ভাগের এক ভাগ তারা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বাকিরা বিচ্ছিন্ন। তাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাদের আবার নিজস্ব ফার্মও আছে।
সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেন, কাজী ফার্মস ও প্যারাগন গ্রুপ এখন ডিমের বাজারে মূল খেলোয়াড়। দেশে পোলট্রি শিল্প নিয়ে তিনটি সমিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারাই এগুলো গঠন করেছেন বাজার তাদের দখলে রাখার জন্য। তিনি বলেন, বাজারে যে ডিমের এত দাম তা কিন্তু খামারিরা পায় না। একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হয় ১০ টাকা। ৪০-৫০ পয়সা বেশি দামে খামারিরা বিক্রি করতে পারেন। লাভের টাকা চলে যায় করপোরেটদের হাতে।
সূত্রমতে, ভোক্তা অধিদপ্তর ছাড়াও গত বছর আগস্টে কাজী ফার্মস, প্যারাগন, সিপি, ডায়মন্ড এগ, পিপলস ফিডসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে প্রতিযোগিতা কমিশন। কমিশন ওই মামলার শুনানিতে প্রতিদিন সকালে কাজী ফার্মস যেভাবে ডিমের দাম ঠিক করে দেয় তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেন আদালত।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা গত বছরের আগস্টে ডিমের বাজার অস্থির হওয়ার পর পুরো বিষয়টি তদন্ত করেছি। আমরা দেখেছি বাজারে সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে। আমরা অভিযান চালিয়ে মামলা করেছি, জরিমানা করেছি। আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিযোগিতা কমিশন কাজী ফার্মসহ আটটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। কিন্তু তারপরও আবার সিন্ডিকেট সক্রিয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আবার অভিযান শুরু করেছি। কিন্তু সমস্যা হলো, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ কত, তা তো আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানা নেই। এটা বলতে পারবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। তারা যদি আমাদের জানায় একটি ডিমের উৎপাদন খরচ কত, তাহলে বাজারে কত দামে বিক্রি হচ্ছে তা দেখে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি।’ তা না হলে অভিযান চালিয়ে লাভ হবে না বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে কারওয়ান বাজারে অভিযান চালিয়ে এক ব্যবসায়ীকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গতকাল কাপ্তান বাজারে অভিযান চালিয়ে আরও তিন দোকানিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল সরেজমিন ভোক্তা অধিকারের অভিযানে দেখা যায়, ডিমের উৎপাদক ও বাজারজাতকারী কাজী ফার্মস, নাবিল, ফিনিক্স, রানা, প্যারাগন ও ডায়মন্ডের মতো প্রতিষ্ঠান তাদের তালিকাভুক্ত ডিম বিক্রেতাকে রশিদ দিলেও, তাতে বিক্রয় মূল্য লিখে দিচ্ছে না।
সুমন হাওলাদার বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠান যদি শুধু বাচ্চা ও ফিড উৎপাদন করে, আর খামারি যদি ডিম আর মাংস উৎপাদন করে তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ভোক্তাদের স্বস্তি মিলবে। অন্যথায় মাঝে মধ্যেই এভাবে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।