লাইবরের বিদায়ে সোফর নিয়ে বিপাকে বিদ্যুৎ খাত!

ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ খাতে গত কয়েক বছরে নেয়া হয়েছে সরকারি বেশকিছু বড় প্রকল্প। তবে বেশির ভাগ প্রকল্প কঠিন শর্তের বায়ার্স ক্রেডিট বা ইসিএ (এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সি) ঋণে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গ্রেস পিরিয়ডসহ এসব ঋণ ১২-১৫ বছরে পরিশোধ করতে হবে। আর সুদহার ছিল ছয় মাস মেয়াদি লাইবর (লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফার রেট) প্লাস ৩-৪ শতাংশ।

গত ৩০ জুন বিলুপ্ত হয়েছে লাইবর। ফলে এসব ঋণের জন্য সুদ হবে ছয় মাস মেয়াদি সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) প্লাস ৩-৪ শতাংশ। যদিও ঋণ নেয়ার সময় লাইবর হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এতে দেড় বছর আগেও এসব ঋণের জন্য সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার শতাংশ সুদ দিতে হতো। তবে বর্তমানে সোফর ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ছয় মাস মেয়াদি সোফর ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অর্থাৎ ইসিএ ঋণের সুদহার দাঁড়াবে আট থেকে ৯ শতাংশ।

তথ্যমতে, বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে কঠিন শর্তের ঋণ রয়েছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার কোম্পানি পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ঋণ নিয়েছে প্রায় এক হাজার ৮০০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৭৮০ মিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ এক হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ডলার।

এর বাইরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আট প্রকল্পে ইসিএ ঋণ এক হাজার ৮০ মিলিয়ন ডলার, আশুগঞ্জ ও ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬১০ মিলিয়ন ডলার, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ৪০০ মিলিয়ন ডলার এবং বি-আর পাওয়ারজেনের ঋণ ১৫০ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া সঞ্চালন লাইন নির্মাণে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ রয়েছে চার হাজার ৪২৯ মিলিয়ন ডলার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানির ঋণে বাংলাদেশ সরকারের সভরেন গ্যারান্টি দেয়া ছিল। ফলে এসব ঋণের সুদহার ছয় মাস মেয়াদি লাইবর প্লাস (গড়ে) ৩ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে লাইবর ছিল ০.৩১ শতাংশ। এতে গড়ে এসব ঋণে সুদ দিতে হতো ৩.৩১ শতাংশ। তবে বর্তমানে ছয় মাস মেয়াদি সোফর দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। ফলে ঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে গড়ে প্রায় ৮ শতাংশ।

এদিকে বেসরকারি ঋণে সভরেন গ্যারান্টি না থাকায় সুদহারও বেশি। বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি এসব ঋণের গড় সুদহার ছিল লাইবর প্লাস ৪-৪.৫ শতাংশ। ফলে বেসরকারি ঋণের জন্য আগে সুদ গুনতে হতো ৪.৩১ থেকে ৪.৮১ শতাংশ। তবে ছয় মাস মেয়াদি সোফরের উচ্চ হারের কারণে সুদের হার গিয়ে ঠেকেছে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত। এতে ইসিএ তথা বায়ার্স ক্রেডিটের সুদ পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতই।

সরকারি প্রকল্পগুলোতে উচ্চ সুদহারের কারণে ক্যাপাসিটি পেমেন্টও বেড়ে যাবে বলে জানান পিডিবির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের সুদহার ছিল ছয় মাস মেয়াদি লাইবর প্লাস দুই দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর ঋণ নেয়ার সময় লাইবর ছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এখন ছয় মাস মেয়াদি সোফর প্রায় পাঁচ শতাংশ। এতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের জন্য শুরুতে যে সুদহার ছিল তিন দশমিক ৩৫ শতাংশ, এখন তা দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর এ সুদের হারের সঙ্গে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ জড়িত। তাই ক্যাপাসিটি চার্জও বেড়ে যাবে।

তথ্যমতে, বিদ্যুৎ খাতের ইসিএ ঋণগুলো গড়ে ১২ বছরে পরিশোধ করতে হবে। এতে বছরে আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয় প্রায় এক হাজার ১৪০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি খাতের ৩৭০ মিলিয়ন ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে। আর সরকারি খাতের সুদ বাবদ গুনতে হবে প্রায় ৭৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি খাতে সুদ বাবদ ৪০০ মিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে বছরে।

যদিও ডলার সংকটে ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না। গত কয়েক মাসে এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে। পিডিবির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুৎ খাতকে সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বেসরকারি খাতেও বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ একদিকে বেড়ে গেছে সুদহার, আরেকদিকে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এভাবে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ বিলম্বিত হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০