ক্রমবর্ধমান মানসিক ভারসাম্যহীনতা:নেপথ্যের কারণ

মানুষের স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানসিক ভারসাম্য; যার ওপর ভর করেই শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে পরিচালনার মাধ্যমে ব্যক্তি যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে থাকে। অন্য সব অঙ্গের চেয়ে মস্তিষ্কের সুস্থতা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিককালে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। গবেষকদের মতে, তিনটি বিষয় মানসিক রোগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  যেমনÑ বংশগত, মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন এবং পরিবেশ এবং সামাজিক প্রভাব।

বংশগত কিংবা জিনগত কারণে মানসিক সমস্যা এটার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত।

স্বাভাবিক সুস্থ মস্তিষ্ক অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়ে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। অত্যধিক দুশ্চিন্তা, ঘুমের অনিয়ম, একঘেয়েমি, অপ্রয়োজনে অত্যধিক কথাবার্তা বলা প্রভৃতি মানসিক অসুস্থতার কারণ হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্র্রতিক সময়ে ইন্টারনেট কিংবা ভিডিও গেমসে অধিক আসক্তি মানসিক ব্যাধির সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত। সরকারি এক জরিপের তথ্যমতে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা রয়েছে ১৯.৩ শতাংশের, যা আগে ১৬.৪ শতাংশ ছিল। আর ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যাগ্রস্তের হার ১৭.৭ শতাংশ।

সামাজিক কিছু প্রভাবের ফলে মানসিক বিকারগস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। তš§ধ্যে প্রিয়জন বিয়োগ, প্রিয় কোনো কিছু হারানো, নিজের স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণগুলো উল্লেখযোগ্য।

আমাদের দেশে বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে আবার এ মানসিক ভারসাম্যহীনতা নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা কিংবা কুসংস্কারের প্রচলন বিদ্যমান। যখনই কেউ মানসিক বিকারগস্ত হবে, অধিকাংশ মানুষজন মনে করে তাকে জিন বা ভূত আছর করেছে। যার ফলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ না নিয়ে কবিরাজ, দরবেশের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। এতে করে পরিস্থিতি হীতে বিপরীত হওয়ার পাশাপাশি রোগীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে আশঙ্কাজনকের দিকে ধাবিত হতে থাকে।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে মুখ্য কারণÑঅত্যধিক ইন্টারনেট আসক্তি এবং ভিডিও গেমসের আসক্তিকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করা অপরিহার্য। বর্তমানে শুধু শহর-ই নয়; বরং গ্রামের পাড়া-মহল্লাগুলোর মোড়ে, স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণসহ প্রায় সব জায়গায় শিশু-কিশোরদের স্মার্টফোন হাতে ফ্রি-ফায়ার কিংবা পাবজির মতো ভিডিও গেমসে আসক্ত হতে দেখা যায়। একনাগাড়ে এ রকম আসক্তি তাদের ধীরে ধীরে নিয়ে যেতে পারে মানসিক বিকারগস্ত রোগীর তালিকায়। শুধু শিশু-কিশোর নয়, আজকাল প্রাপ্তবয়স্ক লোকজনকেও ইন্টারনেটে আসক্ত হতে দেখা যায়, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আর এ আসক্তিগুলোর কারণেই মূলত পরে সরাসরি মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগে অনীহা দেখা যায়। ফলে, এক ধরনের অবসাদে তাদের সময়গুলো কাটে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম ঝুঁকির কারণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক অসুস্থতার কারণেই সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে এবং এর থেকে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। দেশে ২৫ শতাংশ মানুষ বিষণœতায় ভুগছেন। শুধু তা-ই নয়, মানসিক অসুস্থতার প্রভাবে অনেকে আত্মহত্যা না করে আবার আপনজনকেও অনেক ক্ষেত্রে হত্যা করে ফেলেন।

মানসিক বিপর্যয় চলে আসলে প্রাথমিক পর্যায়েই অভিজ্ঞ সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হওয়ার বিকল্প নেই। সব দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে শান্ত পরিবেশে বিশ্রাম, পরিমিত ঘুম এবং নিয়মিত খাবার গ্রহণ অনেক বেশি অপরিহার্য। অন্যদিকে, সব বাজে আসক্তি বিশেষত অপ্রয়োজনে অত্যধিক ইন্টারনেট ব্যবহার ও ভিডিও গেমসের আসক্তি থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই মঙ্গল। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক এবং সচেতন নাগরিকদের ভূমিকা অনেক বেশি প্রয়োজন। সর্বোপরি, এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। আগামীর একটা সুন্দর সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমাদের আশা, ভরসা ও নির্ভরতার প্রতীক তরুণ সমাজকে সঠিক মূল্যবোধের চর্চা এবং তাদের সুস্থ মানসিক বিকাশ সাধনের নিমিত্তে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া উচিত, তবেই আমাদের স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ সহজতর হবে।

আবু আখের সৈকত

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০