ইসমাইল আলী ও রোহান রাজিব: বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেয়ার পর (২০০৬ সাল শেষে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। তবে বর্তমান সরকারের সময়ে বিশেষত তৃতীয় মেয়াদ তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এতে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১৬ বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৪০৯ শতাংশ বা চার গুণের বেশি।
এই সময়ে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
সূত্রমতে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ে বিএনপি। এর দুই মাস পর (ওই বছর ডিসেম্বরে) বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সিংহভাগই ছিল সরকারি খাতের ঋণ। এর পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
এরপর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুই বছর ক্ষমতা থাকেন ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকার। ওই দুই বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সাল শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতের ঋণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের ছিল ১ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। পরের পাঁচ বছরে বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৩৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে এ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। ওই পাঁচ বছরেও সবচেয়ে বেশি ঋণ বেড়েছে সরকারি খাতের ঋণ। এ সময় সরকারি খাতে ৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার বেড়ে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণ ২ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার।
ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে বিদেশি ঋণ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন বাড়লেও, ২০১০ সালে তা প্রায় ৮৩৬ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পায়। তবে পরের বছর তা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বাড়ে। যদিও ২০১২ ও ২০১৩ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার করে।
২০১৪ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। পরের পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮ সাল) দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায়। ওই পাঁচ বছরে বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৭৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সাল শেষে বিদেশি ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পাঁচ বছরে বিদেশি ঋণ বাড়ে ২৫ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার।
সে পাঁচ বছরে সরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার। ফলে ২০১৮ সাল শেষে এ খাতের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছিল ৪৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ওই পাঁচ বছরে বেসরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধি পায় ৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সাল শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ স্থিতি ছিল ১২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালেই বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পায় ৫ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তবে পরের বছর তা মাত্র ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার বাড়ে। ২০১৬ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে রেকর্ড ৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ও ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম চার বছরে বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৯ শতাংশের বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৫৭ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সাল শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চার বছরের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
এ চার বছরে সরকারি খাতে ২৭ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার বেড়ে বৈদেশিক ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শর্ট টার্ম ঋণ ছিল ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন আর লং টার্ম ঋণ ৭০ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। আর গত চার বছরে বেসরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সাল শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শর্ট টার্ম ঋণ ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন আর লং টার্ম ঋণ ৭ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার।
গত চার বছরে বিদেশি ঋণ সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে বাড়ে ৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে ৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন, ২০২১ সালে রেকর্ড ১৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ও ২০২২ সালে ৫ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে শুধু সরকারি ঋণ বৃদ্ধি পায় ৯ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন আর বেসরকারি ঋণ বাড়ে ৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা ছিল। তখন বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক কমে যায়। ওই সময়ে ডলারের চাহিদাও কমে। এতে অনেক দেশ তখন ঋণ পরিশোধ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে উল্টোটি। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তার মাধ্যমে ঋণের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। ঋণ পরিশোধের শর্ত শিথিল করে। কম সুদ এবং সহজ শর্তের কারণে ব্যবসায়ীরাও বিদেশ থেকে প্রচুর ঋণ নিতে থাকেন। ফলে ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ বৃদ্ধি পায়।
অপরদিকে ২০২২ সালে ঋণ কমার অন্যতম কারণ ছিল ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি। এছাড়া বিশ্বব্যাপী সুদহারও বাড়তে শুরু করে এ সময়। এতে ডলার সংকটের পাশাপাশি ঋণ পরিশোধে খরচ অনেক বেড়ে যায়। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ মাত্র সোয়া ১ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।
বেসরকারি উদ্যোক্তারা বলছেন, গত বছরের শুরুতে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৫ টাকা। ডিসেম্বরের শেষে তা দাঁড়ায় ১০৭ টাকা। এর মানে, শুধু বিনিময় হারজনিত কারণে প্রতি ডলারে খরচ বেড়েছে ২২ টাকা। সুদহারও কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০২১ সালের শুরুতে সব ধরনের খরচসহ স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের সুদহার ছিল ৩ শতাংশের কম। এখন সেই ঋণে সুদ গুনতে হচ্ছে ৯ শতাংশের বেশি। আবার বিনিময় হার বা সুদহার এ পর্যায়ে স্থিতিশীল থাকবে কিনা তা কেউ বলতে পারছে না। অভ্যন্তরীণ ঋণের তুলনায় বিদেশি ঋণের খরচ বেশি হওয়ায় একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিদেশি ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এতে বিদেশি ঋণের প্রতি ঝোঁক কমে আসে।