প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম : ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভা নিধনে জৈব কীটনাশক বিটিআইয়ের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আরও বড় হচ্ছে। মার্শাল অ্যাগ্রোভেট নামে সেই কোম্পানি কাগজপত্র জালিয়াতি করে বন্দর থেকে কীটনাশকের চালানটি খালাস করেছে বলে কাস্টমস কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন।
এ ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের পক্ষ থেকে গত বুধবার মার্শাল অ্যাগ্রোভেট এবং তাদের নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বন্দর থানায় মামলা করা হয়েছে।
মার্শাল অ্যাগ্রোভেট দাবি করেছে, তারা সিঙ্গাপুরের কোম্পানি ‘বেস্ট কেমিক্যালস’ উৎপাদিত বিটিআই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের হাতে তুলে দিয়েছে। তবে বেস্ট কেমিক্যালস জানিয়েছে, তারা মার্শালকে কোনো বিটিআই দেয়নি। এরপর জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
এই ঘটনায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মার্শাল অ্যাগ্রোভেটকে কালো তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। গত ২১ আগস্ট রাতে গুলশান থানায় করা প্রতারণার মামলায় মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এক পরিচালক এবং চীনের নাগরিক আর লি কিওয়াংকে আসামি করা হয়।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভা নিধনে জৈব কীটনাশক বিটিআই প্রয়োগের কাজ গত ৭ আগস্ট উদ্বোধন করেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এই কীটনাশকের পুরো নাম ব্যাসিলাস থুরিংয়েইনসিস ইসরায়েলেনসিস। সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ৫ টন বিটিআই আনা হয়েছে বলে সেদিন জানিয়েছিল ডিএনসিসি।
সেই অনুষ্ঠানে লি কিওয়াংকে বেস্ট কেমিক্যালসের ‘বিটিআই বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। পরে জানা যায়, তিনিও বেস্ট কেমিক্যালসের পদে নেই।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. বাকী বিল্লাহর করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, মার্শাল অ্যাগ্রোভেট চীন থেকে পাঁচ টন ইনসেক্টিসাইড: ব্যাসিলাস থুরিংয়েইনসিস ইসরায়েলেনসিস ১২০০ আইটিইউ/এমজি ডব্লিউপি (বিটিআই) আমদানি করে। আমদানি করা পণ্য চালানটি খালাসের জন্য তার মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট তাইবোলি এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে গত ২৬ জুলাই বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে।
পরে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কর্মী সরকার জাকির হোসেন ও শহিদুল ইসলাম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র কাস্টমসে দাখিল করেন। কাস্টমস হাউসের পক্ষ থেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কীটনাশক আমদানির লাইসেন্সের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
গত ২২ আগস্ট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তাদের জবাবে কাস্টমসকে জানায়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির দাখিল করা আমদানি লাইসেন্সের সঙ্গে তাদের দপ্তরে সংরক্ষিত লাইসেন্সের গরমিল আছে।
মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের জমা দেয়া নথিপত্রে তাদের ‘সার্টিফিকেট অব রেজিস্ট্রেশন অব পেস্টিসাইড’ সনদে লাইসেন্স টু এনেক্সার-এ এর ২৯ নম্বর ক্রমিকের বালাইনাশকটির নাম ‘বিটিআই’ দেখানো হয়।
কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে সংরক্ষিত মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের সনদে লাইসেন্স টু এনেক্সার-এ এর ২৯ নম্বর ক্রমিকের বালাইনাশকটির নাম উল্লেখ আছে ‘কোরাডেক্স-৫০ এসপি’। ‘বিটিআই’-এর সক্রিয় উপাদান ‘ব্যাসিলাস থুরিংয়েইনসিস’। আর মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের আমদানির অনুমতি থাকা ‘কোরাডেক্স-৫০এসপি’র সক্রিয় উপাদান ছিল ‘সাইরোমেজাইন’।
কাস্টমসের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, “কাস্টমস হাউসে মিথ্যা ডকুমেন্ট উপস্থাপন করে কাস্টমস আইনের বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে ‘চোরাচালানের’ মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে উপরোক্ত ঘোষিত পণ্য (বিটিআই) আমদানি করা হয়েছে।”
তাই বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪-এর ২৫ (বি) এবং দণ্ডবিধির ৪৬৭, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারায় থানায় মামলাটি করা হয়।
কাস্টমস হাউসে দাখিল করা মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের কীটনাশক আমদানির সনদ গ্রহণের তারিখ ২০ অক্টোবর ২০২২। যেটি পরিচালক আব্দুল মাজেদের স্বাক্ষরিত। কিন্তু আব্দুল মাজেদ ওই বছরের ৩০ জুন অবসর পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) চলে যান বলে কাস্টমসের করা মামলায় উল্লেখ।
আর ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর বালাইনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (পিটাক) ৭৯তম সভায় অনুমোদিত মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের মূল সনদে স্বাক্ষর আছে তৎকালীন পরিচালক এজেডএম সাব্বির ইবনে জাহানের।
ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জৈব বালাইনাশক বিটিআই প্রয়োগের উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এর অংশ হিসেবে পাঁচ টন ব্যাসিলাস থুরিংয়েইনসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই সংগ্রহ করে তারা।