ইছামতী নদীর তীরে ২০০ বছরের নৌকার হাট

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ :গ্রামে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় কমতে শুরু করেছে নৌকার চাহিদা। তবে চাহিদা কম থাকায় কদর কমেছে এ নৌকা তৈরির কারিগরদের। দিনে দিনে ঘনিয়ে আসছে তাদের দুর্দিন। বিভিন্ন জায়গায় কোষা নৌকার হাট দেখা না গেলেও মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের বাড়ৈখালী ইউনিয়নের শিবরামপুরে ইছামতী নদীর তীরে ২০০ বছর ধরে বসে কোষা নৌকার হাট। সপ্তাহের প্রতি শনিবার বিভিন্ন সাইজের কোষা নৌকার পসরা সাজিয়ে বসেন নৌকা বিক্রেতারা। সপ্তাহে দুই শতাধিক নৌকা বিক্রি হয় এ হাটে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে উঠে প্রাচীন এ হাট।

জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর ও সিরাজদিখানের ইছামতি নদী ও আড়িয়ল বিলকেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় বর্ষাকালে একসময় মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা ছিল এ কোষা নৌকার। বর্ষা এলেই এ দুই উপজেলায় নৌকা-বিশেষত কোষা তৈরির ধুম পড়ে। নৌকার কারিগরদের এখন দম ফেলার ফুসরত নেই। নৌকা বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। মেহগনি, কড়ই আর চাম্বলের পাশাপাশি মাটিয়া তেল, আলকাতরা, তারকাঁটা, গজালের পসার এখন জমে উঠেছে। কারণ এসব কাঠ, আলকাতরা আর তেলই হচ্ছে নৌকা তৈরির প্রধান উপকরণ।

উপজেলার নিচু অঞ্চলের বাসিন্দাদের বর্ষায় যাতায়াতের একমাত্র ভরসা এ কোষা নৌকা। সে জন্যই মুন্সীগঞ্জ সিরাজদিখান উপজেলার সিরাজদিখান বাজার, ইছাপুরা বাজার, তালতলা বাজার ও ভবানীপুর গ্রামে নৌকা তৈরি ও বিক্রি ধুম পরে। মূলত বর্ষায় জমিতে কৃষিকাজ না থাকায় বছরে তিন-চার মাস নৌকা তৈরি ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে শত শত পরিবার। বর্ষা শেষে এ কারিগররা তথা কাঠমিস্ত্রিরা ঘর ও আসবাপত্র তৈরির কাজ করেন।

নৌকার চাহিদা পূরণে ঐতিহ্যবাহী শিবরামপুরের হাটে ব্রিটিশ আমল থেকেই সপ্তাহে এক দিন বসে নৌকার হাট। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই নৌকা নিয়ে হাটে আসেন জানালেন নৌকা বিক্রেতারা। এ হাটে ৩ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকায় নৌকা বিক্রি হচ্ছে। তবে নৌকা বিক্রি করে এখন আর তেমন লাভ হয় না বলে জানান বিক্রেতারা। আগের মতো বহতা নেই ইছামতী নদীর। জৌলুস হারিয়েছে আড়িয়ল বিল। আশপাশের জলাশয় ভরাট করে ফেলায় কমেছে নৌকার চাহিদা। এ কারণে ভালো নেই নৌকা তৈরির কারিগররা।

একটা সময় পাল তোলা নৌকার কদর ছিল বেশ। উপজেলাজুড়ে চলত বাহারি পালতোলা নৌকা। এছাড়া হাটবাজার থেকে পণ্যসামগ্রী ও জমি থেকে ধানপাট কেটে আনা-নেয়ায় ডিঙ্গি নৌকা বা কোষার ব্যবহার হতো। এছাড়া এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হতো কোষা নৌকার। তবে রাস্তাঘাট হয়ে যাওয়ায় এখন রকমারি সব নৌকার ব্যবহার উঠে গেছে। এতকিছুর পর এখনও গ্রামীণ জীবনে কদর রয়েছে কাঠের তৈরি জলযানটির। বর্ষার পানিতে গ্রামীণ জনপদের খাল-বিলও বাড়ির চারপাশ যখন থইথই করে তখন কোষা নৌকার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করেন বাসিন্দারা। পুরো বর্ষা মৌসুমে নদ-নদী আর খাল-বিলে নৌকায় করে দিনরাত মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জেলেরা।

নবাবগঞ্জ ভাঙাভিটা গ্রামের কোষা নৌকা বিক্রেতা চান গোপাল মণ্ডল বলেন, ‘২০০ বছরের বেশি হইব এখানে হাট বসে। আমার বাপ-দাদারা এ হাটে নৌকা বিক্রি করছে। আমরাও এ হাটে নৌকা বিক্রি করতে আইছি। আগে নৌকা বানানোর লোক কম আছিল। এখন লোক হইয়া গেছে বেশি। নৌকা বিক্রি হয় ৫০টা, লইয়া আসে ১০০টা। ৫০টা থাইক্কা যায়। পানি কইমা যাওয়ায় দাম কইমা গেছে। এখন নৌকা বানাইতে খরচ হয় ২ হাজার ৫০০ টাকা, কাস্টমার আইয়া বলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। রোজের টাকা উঠাতে কষ্ট হইয়া যায়।’

কোষা নৌকা বিক্রেতা নুরুল হক বলেন, ‘নবাবগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা থেকে অনেকেই এ হাটে কোষা নৌকা কিনতে ও বিক্রি করতে আসেন। কোষা বেশি আসে সিরাজদিখানের শেখেরনগর গ্রাম, সিরাজদিখান বাজার, ইছাপুরা বাজার, তালতলা বাজার ও ভবানীপুর গ্রাম থেকে। এছাড়া নবাবগঞ্জের বাগমারা, ভাঙাভিটা এলাকা থেকেও আসে অনেকে। তবে সব জায়গায় রাস্তাঘাট হয়ে যাওয়ায় এখন আর তেমন কোষা কিনতে আসে না কাস্টমাররা। বড় একটা কোষা বানাতে ৪-৫ হাজার টাকা লাগে, কাস্টমার ২-৩ হাজার টাকার বেশি বলে না।’

আরেক কোষা নৌকা বিক্রেতা আজম শেখ বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০০ কোষা বিক্রি হয় এ হাটে। পানি কমে যাওয়ার কারণে কোষা বিক্রি কমে গেছে। পানি বেশি হলে কোষা বিক্রিও বেড়ে যায়, লাভও ভালো হয়।’ 

সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামের কোষা তৈরির কারিগর কৃষ্ণ মণ্ডল ৩২ বছর ধরে নৌকা তৈরি করে আসছেন। বৃদ্ধ এ কারিগর বলেন, ‘এবার পানি না থাকায় কোষা বিক্রি কমে গেছে। এখন চাম্বল আর কড়ই কাঠের নৌকা বানাই। সাধারণত ৮-১২ হাত দৈর্ঘ্যরে নৌকা তৈরি করে থাকেন। তবে কেউ অর্ডার করলে অনেক বড় নৌকা বানানোর চুক্তিও তিনি করেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০