পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ১১৫ কোটি টাকা লোকসানে প্রিমিয়ার ব্যাংক

আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে গত ২০২২ হিসাব বছরে ১১৫ কোটি টাকা লোকসানে ছিল ব্যাংকিং খাতের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। গত বছর ব্যাংকটি শেয়ারে মোট ৩৭৪ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ ব্রোকারেজ ও ডিলার হিসাব মিলিয়ে মোট প্রায় ১৪ কোটি টাকা শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে। এ সময় ব্যাংকটির নিজস্ব পোর্টফোলিওতে থাকা বিনিয়োগের বাজার মূল্য কমেছে প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। আর সিকিউরিটিজ হাউস গত বছর ব্যবসায় লোকসান করেছে ১০ কোটি টাকার বেশি। এতে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ শেষে ব্যাংকটির সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ পুঁজিবাজারে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের বিপরীতে প্রায় ১১৫ কোটি টাকা লোকসানে ছিল।

ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৩১ ডিসেম্বর শেষে পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির ৯৮টি কোম্পানির ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৯৮ হাজার ২৩৭টি শেয়ারে বিনিয়োগ ছিল ২৯৩ কোটি ৯৩ লাখ ১৫ হাজার ৫ টাকা, যা আলোচ্য সময় শেষে শেয়ারগুলোর দর কমে দাঁড়িয়েছে ১৯৫ কোটি ২৮ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ টাকা। এতে শেয়ারদর কমে যাওয়ায় ব্যাংকটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯৮ কোটি ৬৪ লাখ ২৫ হাজার ৬ টাকায়। এদিকে একই সময়ে ব্যাংকটি তালিকাভুক্ত ৩টি ফান্ডের ৮০ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৯টি ইউনিটে বিনিয়োগ করেছিল ৬ কোটি ৪২ লাখ ৯৩ হাজার ৩০১ টাকা, যা ৩১ ডিসেম্বর শেষে দর কমে দাঁড়িয়েছিল ৫ কোটি ১ লাখ ৩০ হাজার ১৭৫ টাকায়। সে হিসাবে ফান্ডের বিনিয়োগে ব্যাংকটির লোকসান হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৬৩ হাজার ১২৬ টাকা। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটির বিনিয়োগ করা ৯৮টি কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে এ ক্যাটেগরি শেয়ারের সঙ্গে দুর্বল আর কারসাজির শেয়ারও ছিল। এর মধ্যে প্রথমেই হচ্ছে সিএনএ টেক্সটাইল, আরএসআরএম লিমিটেড, রিং শাইন টেক্সটাইলের মতো কিছু শেয়ার। যেসব কোম্পানির দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকটির বিনিয়োগকৃত শেয়ারের মধ্যে দুর্বল কোম্পানি যেমন এবি ব্যাংক, বিচ হ্যাচারি, কেয়া কসমেটিকসের মতো বেশ কিছু শেয়ার রয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকটির ফরচুন সুজ, জেনেক্স ইনফোসিস, অগ্নিসিস্টেম এবং বেশ কিছু ইন্সুরেন্সসহ কারসাজির শেয়ারেও বিনিয়োগ রয়েছে।

এদিকে ব্যাংকটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত হিসাব বছরে সিকিউরিটিজ হাউসের নিজস্ব পোর্টফোলিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে ১২ কোটি ৭৯ লাখ ৯৮ হাজার ২৫১ টাকা বিনিয়োগ করেছে, যা তার আগের বছর ২০২১ সালে ছিল ১৩ কোটি ৯০ লাখ ৮ হাজার ২৪৫ টাকা। ২০২২ হিসাব বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকৃত শেয়ার বিক্রি থেকে লোকসান হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সিকিউরিটিজ হাউজে প্রিমিয়ার ব্যাংকের স্বল্প মেয়াদে ঋণ রয়েছে ১৬৮ কোটি ৮৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৯ টাকা, যা আগের বছরে ছিল ১৫৯ কোটি ৫১ লাখ ৩০ হাজার ৯১২ টাকা। আর দীর্ঘ মেয়াদে সিকিউরিটিজের ঋণ রয়েছে ৫০ কোটি টাকা।

গত বছর ব্যাংকটির ব্রোকারেজের গ্রাহকদের শেয়ার কেনাবেচা থেকে কমিশন, মার্জিন ঋণ থেকে আয় এবং শেয়ারে বিনিয়োগসহ মোট পরিচালন আয় আগের বছরের থেকে কমেছে। ২০২২ সালে ব্রোকারেজ হাউসটির কমিশন থেকে আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৩৮ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, যা আগের বছরে ছিল ২২ কোটি ৪৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এ সময় মার্জিন ঋণের সুদ থেকে আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৩২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, যা আগের বছরে ১৫ কোটি ১৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ছিল। আলোচ্য সময়ে শেয়ারে বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছে ৯৮ লাখ ৩ হাজার টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৫ কোটি ৫ লাখ ৬ হাজার টাকা। সে হিসাবে ব্রোকারেজটির গত বছর পরিচালন আয় হয়েছে ৩০ কোটি ৫৭ লাখ ৪১ হাজার টাকা। যা আগের বছরে ছিল ৪৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। এতে ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটির আয় কমেছে ১৩ কোটি ৩৭ লাখ ১২ হাজার টাকা।

অন্যদিকে ২০২২ সালে ব্রোকারেজ হাউসটির কর পরবর্তী লোকসান হয়েছে ১০ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা আগের বছরে কর পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছিল ১ কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এছাড়া গত বছর ডিলার অ্যাকাউন্টে ব্রোকারেজের বিনিয়োগ পজিটিভ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ ৯ হাজার টাকা, যা আগের বছর নেগেটিভ ছিল ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। ব্রোকারেজ ও ডিলার অ্যাকাউন্ট মিলে গত বছরে পুঁজিবাজারে সিকিউরিটিজ হাউসটির ক্রয় মূল্যে বিনিয়োগ ছিল ১৮ কোটি ৮২ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। যার ৩১ ডিসেম্বর শেষে বাজার মূল্য ৬ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা কমে দাঁড়ায় ১২ কোটি ৭৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকায়। এর মধ্যে এ ক্যাটেগরির শেয়ারে ক্রয় মূল্যে বিনিয়োগ রয়েছে ১৫ কোটি ২৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা। যার বাজার মূল্য ৩১ ডিসেম্বর শেষে ছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ২১ হাজার টাকা। আর বি, জি এবং এন ক্যাটেগরির শেয়ারে ক্রয় মূল্য হিসেবে বিনিয়োগ ছিল ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। যার আলোচ্য সময় শেষে বাজার মূল্য কমে হয়েছে ২ কোটি ১৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

এদিকে গত বছর ব্যাংকটি পুঁজিবাজার বিনিয়োগে বিশেষ তহবিলে ২০০ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সব তফসিলি ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করার অনুমতি দেয়। কিন্তু প্রিমিয়ার ব্যাংক এ সুযোগ থাকলেও মাত্র ৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ব্যাংকটি মোট ২৪টি কোম্পানির ৭৯ লাখ ৮৪ হাজার ২৯৮টি শেয়ারে ৬৯ কোটি ৭৯ লাখ ১২ হাজার ১৩৫ টাকা বিনিয়োগ করেছে।

এ বিষয়ে জানতে শেয়ার বিজ থেকে প্রথমে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রিয়াজুল করিমকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করা হলে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব দেননি।

পরে ব্যাংকটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. তারেক উদ্দিনকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেন না এবং হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়া হলে তিনি প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুর রউফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

ব্রোকারেজ হাউসের সিইও আব্দুর রউফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকের পোর্টফোলিওর বিষয়ে আমার জানা নেই। এটা ব্যাংকের বিনিয়োগ বিভাগ বলতে পারবে। আমি ব্রোকারেজের সিইও, শুধু এটার বিষয়ে বলতে পারবে। গত বছর ব্রোকারেজের যে মুনাফা বা লোকসান হয়েছে সেটা ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনই প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানেই সব তথ্য দেয়া আছে বলে তিনি জানান।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০