বিশ শতকের ত্রিশের দশকে ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ হয়। এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তাদের চিন্তাভাবনা প্রকাশের মুখপত্রের নাম ছিল ‘শিখা’। মুসলিম সাহিত্যসমাজ তাই ‘শিখাগোষ্ঠী’ হিসেবেও পরিচিত ছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ছিল আমাদের সংস্কৃতির একটি বিবেকী ধারা। এ ধারারই অন্যতম চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিলেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী।
মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রবক্তা, উদার মানবতাবাদী ও মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার রচিত ‘আমাদের দৈন্য’, ‘আদেশপন্থী ও অনুপ্রেরণাপন্থী’ ও ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের চিন্তাধারা’ প্রবন্ধ যথাক্রমে সাহিত্যসমাজের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম বার্ষিক সম্মেলনে পাঠ করা হয়। বাংলা সাহিত্যে পরিশীলিত গদ্যের রচয়িতা হিসেবে তিনি খ্যাত। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার রচনায় সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণ ও মানবতাবোধকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা করেন। মনুষ্যত্বের বিকাশ বলতে তিনি বোঝাতেন সংস্কৃতি-সাধনাকে। তাই তাকে সংস্কৃতি-সাধকও বলা হয়।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১৯০৩ সালে বর্তমান নোয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। তিনি কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। এরপর ইউসুফ হাইস্কুলে একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় এমএ পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরী কিশোর বয়স থেকে সাহিত্যে আগ্রহী ছিলেন। তিনি প্রবন্ধ রচয়িতা হিসেবে পাঠকসমাজে সমাদৃত হন। তিনি বিচিত্রা, মাসিক মোহাম্মদী, সওগাত, ছায়াবীথি, বুলবুলসহ বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকাতেও প্রবন্ধ লিখেছেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সংস্কৃতির কথা’। তার প্রবন্ধের গদ্যশৈলীতে প্রমথ চৌধুরী ও মননে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এছাড়া তার অনুবাদ করা দুটি গ্রন্থ হলো ক্লাইভ বেলের ‘সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত ‘সভ্যতা’ এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘কনকুয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ গ্রন্থের অনুবাদ ‘সুখ’। সৈয়দ আবুল মকসুদের সম্পাদনায় ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি রচনাবলি আকারে তার সব রচনা প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনাকালে ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কাজী সালমা সুলতানা
