প্রতিনিধি, রাজশাহী : নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার। একের পর এক হুশিয়ারি উচ্চারণের পর এবার ৩টি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ক্রেতাদের উদ্বেগ আর ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্টদের মনিটরিংয়ের পরও লাগাম টানা যাচ্ছে না আলুর দাম বৃদ্ধির। গত এক মাসের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রতি কেজিতে আলুর দাম বেড়েছে আর ১৫ টাকা। এতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে সাধারণ ভোক্তাদের মাঝে।
গত শুক্রবার থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দিলেও সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা ও অসহযোগিতায় সরকারি এ নির্দেশনা রাজশাহীতে উপেক্ষিত। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানেও ভাঙছে না সিন্ডিকেট।
জানা গেছে, রাজশাহীর হিমাগারগুলোতে এখনও চাহিদার চেয়ে বেশি আলু মজুত আছে। কিন্তু তারপরও এর প্রভাব বাজারে নেই। আরও দাম বৃদ্ধির আশায় হিমাগার থেকে আলু ছাড়ছে না এই সিন্ডিকেট। ফলে আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা সরকারি নির্দেশনার পরও শুক্রবার রাজশাহীর বাজারে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা কেজি দরে। গত আলু সংগ্রহ মৌসুমে বড় বড় কয়েকটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মাঠ থেকে ১৮ থেকে ২০ টাকা কেজিদরে আলু কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করে। হিমাগারে ৫৫ কেজি থেকে ৬০ কেজির এক বস্তা আলু সংরক্ষণে এক মৌসুমের ভাড়া লাগে ১২০ থেকে ১৩৫ টাকা। সেই হিসাবে এক কেজি আলু সংরক্ষণে হিমাগার ভাড়া লাগে ২ টাকা ২৫ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে শতকরা ১০ ভাগ মুনাফা যোগ ও পরিবহন ভাড়াসহ হাতবদল হয়েও আলুর কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকার বেশি হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু আলুর কেজি ৫০ টাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে মনে করেন ক্রেতারা। রাজশাহীর একজন হিমাগার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হিমাগার থেকে বর্তমানে অল্প অল্প করে আলু বাজারে ছাড়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন বাজারে আলুর দামের খোঁজখবর রাখছেন। অনেকেই আলু উত্তোলন করে দেশের বিভিন্ন জেলায় চালান করছেন।
ভোক্তারা বলছেন, এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যে সিন্ডিকেশন দৌরাত্ম্য। সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবছে না। আজকে সরকার দাম বেঁধে দিলেও বাজারে গিয়ে বোকা বনে যেতে হয়েছে গ্রাহকদের। অথচ কোনো পণ্যের দাম যদি বাড়ার ঘোষণা আসত; তাহলে এক দিন আগেই কার্যকর হয়ে যেত। যেমন ডিমের দাম গত সপ্তাহেও ১১ টাকা করে রাজশাহীতে বিক্রি হয়েছে। সরকারি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা দাম ১২ টাকা নিতে শুরু করেছেন। কিন্তু আলুর দাম আর কমল না। এর স্থায়ী সমাধানের কথা বলছেন ভোক্তারা।
সাহেববাজার মাস্টারপাড়া কাঁচাবাজারের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী মিরাজ হোসেন বলেন, বাজারে আলু নেই। আজও আলু আসেনি। গতকাল পর্যন্ত যা কিনেছি তা বিক্রি করছি। সরকারের নির্ধারিত দাম বিকালে হয়েছে। আমরা তো সকালে কিনেছি। তাই আজ বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। আগামী দিন থেকে নির্ধারিত দামের মধ্যে আমরা পেলে আমরাও বিক্রি করব। বর্তমানে কেজি প্রতি আলুর পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৪১ টাকা দরে।
সাহেববাজার খুচরা বাজারের বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম বলেন, আলু ও পেঁয়াজ বাজারে মিলছে না। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখেন আলু নেই। আমাদের আজও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। বেশি দামে কিনলে তো বেশি দামেই বিক্রি করতে হবে।
এদিকে, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমাগার ছাড়াও পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান শুরু করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত বুধবার রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া বাজারের দুটি আড়ত ও দুটি হিমাগারে অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিকার রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের পৃথক টিম। এ সময় হিমাগারের আলু ছাড়ের মূল্য চালানি রসিদ না থাকায় বায়া বাজারের আড়তদার মো. মুকুল হোসেনকে ৫ হাজার টাকা এবং হযরত আলীকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হিমাগার মালিকদের দ্রুত সময়ে বাজারে আলু ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ সেলিম জানান, হিমাগারগুলোতে বিপুল পরিমাণ মজুত থাকতে স্থানীয় বাজারে আলুর কেজি ৫০ টাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়; কিন্তু সেটা হচ্ছে। প্রথমে তারা খুচরা আলু বিক্রেতাদের কাছে ক্রয় রশিদ দেখতে চাইলে তারা দেখাতে পারেনি। পরে আড়তে গিয়ে আলু ছাড়ের রসিদ দেখতে চাইলে তারাও দেখাতে পারেনি। আড়তদাররা ভোক্তা অধিকার দলকে জানান, হিমাগার থেকে তাদের আলু ছাড়ের রসিদ দেয়া হয় না।
মোহাম্মদ সেলিম আরও বলেন, নওহাটার ‘হিমালয়’ কোল্ড স্টোরেজের সংরক্ষণ ক্ষমতা ১ লাখ ১০ হাজার বস্তা। ইতোমধ্যে তারা ৬০ হাজার বস্তা আলু ছেড়েছে। বাকি ৫০ হাজার বস্তা এখনও মজুত রয়েছে। অন্যদিকে রহমান কোল্ড স্টোরেজের সংরক্ষণ ক্ষমতা ৩ লাখ বস্তা। তারা ১ লাখ ৭৯ হাজার বস্তা আলু ছেড়েছে। এ কোল্ড স্টোরেজে এখনও ১ লাখ ৩১ হাজার বস্তা আলু মজুত আছে।
