রোহান রাজিব: রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি জনতা ব্যাংক। এ ব্যাংকটি এক সময় ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে কয়েক বছর ধরে নামে-বেনামে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে ব্যাংকটির অবস্থা এখন নাজুক। এসব ঋণ না আদায় করতে পেরে খেলাপিতে শীর্ষ ব্যাংক হিসেবে নাম উঠেছে জনতার।
ঋণ আদায় না করতে পারলেও বড় গ্রাহকদের ঋণ দেয়া বন্ধ করেনি ব্যাংকটি। গত বছরও শীর্ষ গ্রাহকদের মাঝে ১৬ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে তারা। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির শীর্ষ ৩৬ প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৪২১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৭১ শতাংশ। এতে বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমাও লঙ্ঘন করেছে ব্যাংকটি। জনতা ব্যাংকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৩৬ প্রতিষ্ঠান/গ্রুপের কাছে ঋণ স্থিতি ছিল ৬০ হাজার ৪২১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭০ দশমিক ৯১ শতাংশ। যদিও আগের বছর (২০২১ সালে) শীর্ষ ৩১ প্রতিষ্ঠান/গ্রুপের কাছে ঋণ স্থিতি ছিল ৪৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বড় প্রতিষ্ঠানে ঋণ গেছে ১৬ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৬৯ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের বড় গ্রাহকদের ঋণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সাল শেষে হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ ছিল ২১ প্রতিষ্ঠানের কাছে। তবে দেশের আলোচিত ৫টি গ্রুপের কাছেই ব্যাংকটির ঋণ প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহক এননটেক্স গ্রুপ। গ্রুপটির কাছে ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। এরপর বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনে (বিএডিসি) ৪ হাজার ৮৮০ কোটি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি) ৪ হাজার ৩৮৬ কোটি, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিস করপোরেশনে ৪ হাজার ১৭১ কোটি, ওরিয়ন গ্রুপে ব্যাংকটির ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৩৭ কোটি, ক্রিসেন্ট গ্রুপের কাছে ২ হাজার ১৫ কোটি টাকা, থার্মেক্স গ্রুপের কাছে ১ হাজার ৭৯৩ কোটি, বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি করপোরেশনে ১ হাজার ৫১১ কোটি, বেক্সিমকো লিমিটেডে ১ হাজার ৪২১ কোটি, বেক্সিমকো গ্রুপেরই ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেডে ১ হাজার ৩৯৩ কোটি, রানকা গ্রুপে ১ হাজার ৩৭৯ কোটি, রতনপুর গ্রুপে ১ হাজার ২২৭ কোটি, রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডে ১ হাজার ১৩৩ কোটি, ইসেস ফ্যাশন লিমিটেডে ১ হাজার ১২১ কোটি, বসুন্ধরা গ্রুপে ১ হাজার ৭২ কোটি, বেক্সটেক্স গার্মেন্টসে ১ হাজার ৪২ কোটি এবং ক্রিসেন্ট ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন লিমিটেডে ১ হাজার ২৮ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ৯৪৮ কোটি টাকা রয়েছে মিডওয়েস্ট গার্মেন্টসে, বেক্সিমকো ফ্যাশনে ৯০০ কোটি, পেয়ারলেস গার্মেন্টসে ৮৭৩ কোটি, কসমোপলিটনে ৮৫৬ কোটি, সিকদার গ্রুপে ৮২৯ কোটি, অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টস লিমিটেডে ৮০৮ কোটি, নিউ ঢাকা লিমিটেডে ৭৭৩ কোটি, অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লিমিটেডে ৭০২ কোটি, বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেডে ৬৯৪ কোটি, আবুল খায়েরের ঋণ স্থিতি ৬৮৬ কোটি, বে সিটি অ্যাপারেলস লিমিটেডে ৬৭১ কোটি, চৌধুরী গ্রুপে ৬৫৮ কোটি, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনে ৬৫৪ কোটি টাকা, জনকণ্ঠ গ্রুপে ৬৪০ কোটি এবং স্প্রিং অ্যাপারেলস লিমিটেডে ৬৩৭ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
বিতরণকৃত মোট ঋণের কত শতাংশ অর্থ বড় গ্রাহকদের দিতে পারবে, তা ব্যাংক কোম্পানি আইন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রীতিনীতিতে স্পষ্ট করা আছে। ব্যাংককে অল্প কিছু গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতেই এমন বিধান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও জনতা ব্যাংক বিধানটি মেনে ঋণ বিতরণ করেনি। ব্যাংকটি ঋণ পোর্টফোলিওতে বড় গ্রাহকদের দেয়া ঋণের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনতা ব্যাংক তার ঋণ পোর্টফোলিওর ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বড় ঋণ দিতে পারে। যদিও গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বড় গ্রাহকদের কাছে গেছে জনতা ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৬৯ শতাংশ অর্থ গেছে। এ ছাড়া ব্যাংকটি একক গ্রাহকের ঋণের সীমা অতিক্রম করে মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে ৩২ গ্রাহককে।
শুধু বড় গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকটির ঋণ কেন্দ্রীভূত নয়। পাঁচ শাখায়ও কেন্দ্রীভূত হচ্ছে সিংগভাগ ঋণ। ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৭৩ হাজার ৩০৩ কোটি টাকাই বিতরণ করা হয়েছে মাত্র পাঁচ শাখার মাধ্যমে। সে হিসেবে জনতা ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ ঋণই মাত্র পাঁচ শাখায় কেন্দ্রীভূত।
গত বছর ব্যাংকটির প্রতিটি সূচকে নেতিবাচক অবস্থা বিরাজমান ছিল। একদিকে কমেছে আমানত, বেড়েছে ঋণ। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন ঘাটতিও অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। আর ঋণ আদায় না হাওয়ার কারণে নেট ইনকামেও প্রভাব পড়ে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে তা কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে আমানত কমেছে ২০৪ কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা।
এদিকে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণও বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১২ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে যা বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। তাতে এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৮৭৮ বেড়েছে। ফলে ব্যাংকটি বড় অঙ্কের মূলধন সংকটে পড়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে মূলধন ঘাটতি বেড়ে হয় ১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে যা ছিল ৭২৩ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির ১৩ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এর মধ্যে সংরক্ষণ করতে পারে ৫ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। বাকি ৮ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকটিকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত সময় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে। সঞ্চিতি বাড়ায় গত বছর ব্যাংকটির নেট মুনাফাও কমেছে। ২০২১ সালে কর দেয়ার পর নিট মুনাফা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। আর গত বছর ব্যাংকটির মুনাফা হয় ১১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছর মুনাফা কমেছে ১৮৭ কোটি টাকা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম মাহফুজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের যেসব বড় গ্রাহক রয়েছে, তারাই বেশিরভাগ পণ্য আমদানি করে। যদি এসব প্রতিষ্ঠানকে আমদানি করার সুযোগ সৃষ্টি না করে দিই, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ তিনি আরও বলেন, কাগজে-কলমে বিতরণকৃত ঋণ যা রয়েছে, ছাড় করা হয়েছে তার চেয়ে কম। বর্তমানে যেসব ঋণ রয়েছে তার অধিকাংশ নন-ফান্ডেড। ফান্ডেড ঋণ বেশি চলে গেলে ব্যাংক বিপদে পড়ে। অতীতে অর্থাৎ ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালে ফান্ডেড ঋণ বেশি গেছে। যার ফলে জনতা ব্যাংক বিপদে পড়ে যায়। এটাকে সামাল দিতেই ব্যাংক হিমশিম খাচ্ছে। আর নতুন ঋণ না দিলে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে বলবে। তাই নতুন ঋণ দেয়া যেমন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। তেমনি পুরনোদের সামাল দিতে হচ্ছে।